Saturday, August 28, 2010

কিছু লিংক

১।
মানবাধিকার-বিরোধী ফ্যাসিবাদী শক্তিকে রুখে দিতে হবে
: ফরহাদ মজহার
http://www.chintaa.com/index.php/chinta/showArchive2/43/bangla

২। আমাদের কী আর বলার থাকতে পারে! : ফরহাদ মজহার
http://www.chintaa.com/index.php/chinta/showArchive2/67/bangla

৩। দিল্লির সাথে শেখ হাসিনার চুক্তি আত্মঘাতী বশ্যতা : ফরহাদ মজহার
http://www.chintaa.com/index.php/chinta/showArchive2/68/bangla

৪। চিন্তা
http://www.chintaa.com/index.php/chinta/index/bangla

৫। হাইব্রিড ধান বিষয়ে কাজী মামুন
http://www.facebook.com/porimanob#!/note.php?note_id=379940338284

৬। সোনার বাংলাদেশ ব্লগ
http://www.sonarbangladesh.com/article.php?ID=1793

৭। হুমায়ূন আজাদ কর্তৃক অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক --
http://www.sendspace.com/file/s9dguy

৮। সুনৃত সম্পাদকীয়-

http://www.sendspace.com/file/n6i2wh


ঐ পিডিএফ
--
http://www.sendspace.com/file/20jqiz

৯। ভাবান্দোলন--
http://www.sendspace.com/file/u0kedq

Thursday, August 19, 2010

কিশোরী শাহীন, কাশফুল এবং নূরেমবার্গ ট্রায়ালের রেকর্ডভুক্ত নারীর ছবি



মেয়েটি কাশফুল ভালবাসত। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে ফুটত কাশফুল। একদিন বলল আঙ্কল, আমাকে নিয়ে যান। আমি দুর্গা দিদি হতে চাই। শাদা কাশফুল হতে চাই।
এখানে সম্ভব অপু-দুর্গা হওয়া। একটু অপেক্ষা করলেই অপর পার থেকে ট্রেন আসে। কু-উ-উ শব্দ করে। নদীর উপর দিয়ে শ্যামগঞ্জ থেকে হাওয়া মেখে আসে এই ট্রেনটি। আসে পূর্বধলার লোকজন।

শাহীন একদিন পূর্বধলা যেতে চেয়েছিল।

এইসব ১৯৭১ সালের আগের কথা। শাহীনদের বাসাটি ছিল পুকুর পাড়ের পশ্চিপ্রান্তে। ওর আব্বু কাজ করতেন ময়মনসিংহে-- কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক আব্দুর রহিম। পাক আর্মি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলে ঘাঁটি গাড়ে। অনেক লোকজনকে ধরে এনে ছাত্রদের কক্ষের মধ্যে পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে। আমি ১৯৮৪ সালেও দেখেছি আওয়ালের রুমের ফ্লোরে পোড়া মানুষের দাগ। এখনো আছে। আমি এই রুমের মধ্যে কখনো ঘুমোতে পারিনি।

বধ্যভূমিতে শহীদের করোটিতে শ্বেতদ্রোণ ফুল : কেওয়াটখালির কাছে কৃষি বিশ্বদ্যালয়ের অতিথি ভবনের পাশে। আলোকচিত্র : নাইবউদ্দিন আহমদ।
নাইব চাচা--আলোকচিত্রশিল্পী নাইব উদ্দিন আহমদের সম্বল মাত্র একটি রোলিফ্লেক্স ক্যামেরা। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বাঙালিদের ধরে এনে ব্রাশ করে পাকবাহিনীরা মেরে ফেলেছে। নদীর জল হয়েছে লাল। ভেসে গেছে জলের সঙ্গে।
কাশবনের ভিতর থেকে নাইব চাচা দেখেছেন পাশেই গড়ে উঠেছে বধ্যভূমি। এইখানে দিনে রাতে শিয়াল কামড়ে টানাটানি করে সদ্য গুলি করে মারা লাশ। কোনো কোনোটি গলে পচে গেছে। কোনো কোনোটির কেবল করোটি আছে। তার মধ্য দিয়ে শ্বেতদ্রোণ ফুল ফুটেছে। আর উড়ে আসছে শকুন।

একদিন খবর পেলেন শাহীন হাসপাতালে। বাইরে শাহীনের আব্বু মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছেন। একবারে ভেঙে পড়া। তাকিয়ে দেখার শক্তি নেই। ভিতরে শাহানা চিৎকার করে কাঁদছে। মাথার চুলগুলো এলামেলো। আম্মু শাহানাকে ধরে রাখতে পারছেন না। বলছে- আম্মু ওরা আমাকে মেরে ফেলেছে। আমাকে বাঁচাও।

শাহীন তখনো বেঁচেছিল। মরতে মরতে বেঁচেছিল। নরপশু পাকআর্মিরা আত্ম সমর্পন করার পরে তাকে একটি কক্ষ থেকে বের করে আনা হয়েছে। হাঁটতে পারেনা। মুখের চামড়া উঠে গেছে। খুবলে খুবলে খেয়েছে গায়ের মাংস। বলেছে- তোর পেটে সাচ্চা পাকিস্তানী আদমী পয়দা দিয়েছি।
নাইব চাচার পায়ের শব্দ চিনতে পেরেছিল শাহীন। আহা, আমাদের হৃদয়ের বোন এই কিশোরী মেয়েটি। কাশফুল ভালবাসত। কাশফুলের ভিতরে যেতে চেয়েছিল চাচার সঙ্গে। হতে চেয়েছিল ছবি।

গ্রামটির নাম নিলক্ষ্যা। এখানেই পাক আর্মি চলে যাওয়ার পরে এই ছবিটি তুলেছিলেন নাইব চাচা।
চাচাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠেছিল- ওরা আমাকে মেরে ফেলেছে। আমাকে বাঁচান।

শাহীন নামের সেই মেয়েটি বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু মুখ ঢেকে রেখেছিল চুল আর হাতের আড়ালে। মুখ দেখাবার জন্য কিছু তো রাখেনি পাক হানাদার নরপশুরা। তাকে বাসার সামনে থেকে জামাতী নরপশুরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তুলে দিয়েছিল সোহরাওয়ার্দী হলে। পাকিস্তানী হায়নাদের কাছে। কিশোরী মেয়েটির আর কাশবনে যাওয়া হয়নি।

শাহীন এর পরই সত্যি সত্যি মরে গিয়েছিল। কাশবনের পাশে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে। কিন্তু শাহীন রয়ে গেছে নাইব চাচার রোলেক্স ক্যামেরায়। আজও - উনচল্লিশ বছর পরেও। আর তার হাহাকার। নাইব চাচার চোখ ভরে এসেছে জলে। শাহীনের ছবিটি দেখাতে দেখাতে বলেছিলেন-- খোকন, আমার মনের ক্যামেরায় এরচেয়ে অনেক অনেক ভয়ংকর ছবি তোলা আছে। আমি চোখ বুঝলেই দেখতে পাই। সেই সব চোখ ভর্তি ছবি নিয়ে গত ডিসেম্বরে চিরকালের জন্য নাইব চাচার চোখ স্বব্ধ হয়ে গেছে। তিনিও এখন কাশফুল।

ডালাস থেকে মাহাবুব জালাল ভাই একটি ছবি আমাকে পাঠিয়েছেন। বললেন, দেখো। পোলান্ডে হিটলারী বাহিনীরা শাহীনদের মতো মেয়েদের নগ্ন করে হাঁটিয়ে নিচ্ছে কনসেন্ট্রশন ক্যাম্পে। হিটলার বাহিনীকে কিন্তু ছেড়ে দেওয়া হয়নি। তাদের বিচার হয়েছে। বিচার হচ্ছে আজও তাদের সহযোগীদের।


তিনি মুজিব মেহদী আর রোকেয়া কবীরের মুক্তিযুদ্ধ ও নারী গ্রন্থ থেকে একটি পৃষ্ঠা আমাকে পাঠিয়েছেন। লেখা...'মেয়েদের ধরে আনা হলে কে কোথায় যাবে এবং তালিকা অনুয়ায়ী নির্ধারিত অফিসারের কাছে নির্দিষ্ট মেয়েকে পাঠানো হতো। বন্দি হারেস উদ্দিন ১২ নম্বর ব্যারাকের ১০ নম্বর কামরায়ও ৫০ জন নারীকে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি জানান, বন্দি মেয়েদেরকে তিনভাগ করা হতো। প্রথম ভাগে থাকত যুবতী, দ্বিতীয় ভাগে মধ্যবয়সী এবং তৃতীয় ভাগে সন্তানের মাতা। তিনি জানান, স্কুল-কলেজের অল্পবয়েসী কিশোরীদের বিমানে করে ঢাকায়ও পাঠানো হতো। আরেকটি ঘটনায় জানা যায়, ভারতগামী একদল শরণার্থীর সবাইকে হত্যা করে তাঁদের মধ্য থেকে ১৫ জন কিশোরী-যুবতীকে পরণের কাপড় খুলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় কয়েক মাইল হাঁটিয়ে মহেশপুরে নিয়ে আসা হয়। যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত এসব মেয়েদের ভোগ করবার জন্য আটকে রাখা হয়।

কুষ্টিয়ার পাক-ছাউনিতে অজস্র গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে সেখান থেকে একাধিকবার গৃহবধু থেকে শুরু করে অল্পবয়সী সকল মেয়েকে ধরে নিয়ে আসা হয় এবং নয়মাসব্যাপী যথেচ্ছ ভোগ করা হয়। স্বাধীনতার পর এখানকার কেউ কেউ জীবিত অবস্থায় ছাড়া পান।'

শাহীনদের যারা ধরে নিয়েছিল, নির্যাতন করেছিল করেছিল, মেরে ফেলেছিল--তাদেরকে কি ছেড়ে দেওয়া যায়? দেওয়া কি উচিৎ?

এই প্রশ্নটি রেখেছেন জালাল ভাই। তিনি আরেকটি কথা বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের দলিলের অষ্টম খণ্ডে বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র প্রকাশ করেছে। সেগুলো এখন রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। কিন্তু বাংলাদেশে দৃকে'র ডঃ শহীদুল আলম আলোকচিত্রশিল্পীদের কাছ থেকে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সেইসব ছবির স্বত্ত্ব টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছেন। দৃকের মাধ্যমে তিনি অগাধ ধনসম্পদের মালিক। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সম্পদ এই ছবিগুলি তিনি কিভাবে কেনার সুযোগ নিলেন? বিশ্বযুদ্ধের ছবিগুলো কিন্তু কেউ কেনার সাহস করে নি। বাণিজ্য করার কোসেস করেনি। ওগুলো পৃথিবীবাসীর সম্পদ। ডঃ শহীদুল আলম ফরহাদ মজহার ঘরাণার লোক। ফরহাদ মজহারতো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ফ্যাসিবাদি কর্ম বলেই মনে করেন। যুদ্ধপারাধিদের পক্ষে কলম ধরেন। তাঁর সুহৃদ ডঃ শহীদুল আলমের এই মুক্তিযুদ্ধের দলিল ছবিগুলো কিনে নেওয়ার মাজেজাটা কি?

পশ্চিম বঙ্গের কবি গৌতম চৌধুরী বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক মৌলবাদিদের সার্টিফিকেট কেন দিচ্ছেন? বিষয়টা কি??

গৌতম চৌধুরী কবি। তার বাড়ি পশ্চিবঙ্গে। তিনি আমাকে মেইল করেছেন। বলেছেন- রাও ফরমান আলী খান : ঠাণ্ডা মাথার খুনি নোটের একজায়গায় লিখেছেন - "কিভাবে দৈনিক নয়া দিগন্তে ফরহাদ মজহার নামক লোকজন লেখেন- আবহমান বাঙালি চেতনা একটি ফ্যাসীবাদি চেতনা। " - দয়া ক'রে যদি ফ.ম-র ওই লেখাটি পড়ান, কৃতজ্ঞ রইব।

আমি একাত্তরের গণহত্যার কাপালিক রাও ফরমান আলি খানকে নিয়ে একটি নোট লিখেছিলাম। রাও ফরমান আলিরা শুধু ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যা করেনি- তারা হাজার বছরের আবহমান বাঙালি জাতিকে ও চেতনাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। এখনো তা শেষ হয়নি। নানাভাবে রাও ফরমান আলির চেলা চামুণ্ডারা এই কাজটি এখনো করে যাচ্ছে। ফরহাদ মজহার নামের কতিপয় জীবিত ভাঁড় এই কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কবি গৌতম চৌধুরী এটা বিশ্বাস করেননি। মনে করেছেন- আমি বোধহয় বানিয়ে বানিয়ে ‘অকথা-কুকথা’ বলেছি ফরহাদ মজহার সম্বন্ধে। তিনি বারবার আমাকে মেইল করে ফরহাদ মজহারের ওই লেখাটি চাচ্ছিলেন। আমার অত সময় নেই সবার অনুরোধ রক্ষা করার। কিন্তু গৌতম চৌধুরীর বারংবার অনুরোধে আমি লেখাটির লিংক পাঠালাম। এ সংক্রান্ত নানাজনের মন্তব্যের আরেকটি লিংকও তাকে দিলাম। তিনি সেটা পড়ে লিখলেন- ‘ফরহাদ মজহার হলেন জীবিত বাঙালি শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে একজন। ফরহাদ মজহার হলেন বিভাগোত্তর বাঙালি জাতির একজন শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ। সব বিষয়ে যে তাঁর সাথে সবাইকে সহমত হতে হবে, এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। তবে তাঁর চিন্তাকাঠামোর মোকাবিলা করতে চাইলে তা তো করতে হবে চিন্তা দিয়েই। আকথা-কুকথা বলে উড়িয়ে দেবার মতো খড়কুটো তিনি নন ।’

ফরহাদ মজহারতো নিজেকে বাঙালি বলে স্বীকারই করেন না। তাকে কেন জীবিত বাঙালি শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে একজন বলছেন গৌতম চৌধুরী? ফরহাদ মজহার বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ফ্যাসিবাদি হিসাবে স্পষ্টভাবে নির্দেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, 'বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা পরিগঠনের মধ্যে শুধু নয়, ছিল নৃতাত্ত্বিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারণায়, তথাকথিত ‘সমাজতন্ত্রে’ এবং নিরন্তর এক যুদ্ধংদেহি মনোভঙ্গির চর্চায়। ফ্যাসিবাদ মজুদ ছিল আমাদের সেই সকল ধ্যান, ধারণা, আকাংক্ষা ও আবেগের মধ্যে যাকে আমরা কোন দিনই সন্দেহ করি নি, সন্দেহ করতে শিখি নি।' (৭ জুন, ২০০৮, দৈনিক নয়া দিগন্ত)। http://www.dailynayadiganta.com/2009/06/07/fullnews.asp?News_ID=149127&sec=6

তিনি লিখেছেন- ‘মুক্তিযুদ্ধ এখনো আমাদের অধিকাংশের কাছে দুই নৃতাত্ত্বিক সম্প্রদায় ‘বাঙালি’ বনাম ‘পাঞ্জাবি’র লড়াই।’ একাত্তরের পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বীর বাঙালিদের অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করাকে তিনি ধিক্কার দিয়েছেন। বলেছেন- এই অস্ত্র ধারণের কারণে মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। ফরহাদের মতে- যুদ্ধের চেয়ে ‘একটি নির্যাতিত জনগোষ্ঠির প্রতি বে-ইনসাফি এবং নির্যাতিতের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ইত্যাদি রাজনৈতিক প্রশ্নই ছিল মুখ্য’। অস্ত্রের চেয়ে তার মতে ‘নৈতিক শক্তিটাকে বড় করে দেখা দরকার ছিল’। কী মনে হয়- গান্ধী কথা বলছেন!!

প্রশ্ন হল- ফরহাদ মজহার ষাট দশকের সময় থেকে গান্ধিজীর অহিংস পাঠশালায় ভর্তি হননি। গলাকাটা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার নেতা সিরাজ সিকদার একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেও ফরহাদ মজহার তার বিরোধীতা করেন। তখন তিনি কোথায় ছিলেন? কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগানে? সেখানে তাকে দেখা যায়নি। দেশ স্বাধীনের পরে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বিপ্লবী হুমায়ূন কবীরের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। তার গুরু আহমদ ছফা তার ডাইরীতে একথা বলে গিয়েছিলেন ষ্পষ্টভাষায়- নূরুল আনোয়ারের সম্পাদনায় ২০০৪ সালে আহমদ ছফার ডায়েরি নামে একটা বইতে ছফা সাহেব লিখেছেন--
"ভাত খেলাম। কাপড় ধুয়ে দিলাম। ঘুমোলাম। মনওয়ার এবং মসি এসে জাগালো। মসি ছেলেটাকে আমি ভয়ঙ্কর অপছন্দ করি। মনে হয় ছেলেটা কি একটা মতলবে ঘুরছে। আমার ধারণা হুমায়ুনের মৃত্যুরহস্যটা সে জানে। দিনে দিনে এ ধারণাটা আমার মনে পরিষ্কার রূপ লাভ করছে। কেমন জানি মনে হয়, ছেলেটার হাতে রক্তের দাগ লেগে আছে। এ ধরনের ছেলেদের কি করে এড়িয়ে চলবো সেটা একটা সমস্যা। রেবুদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে সম্ভবত। এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করতে পারিনি। আশা করছি এরই মধ্যে নতুন কোনো তথ্য জেনে যাবো। ফরহাদ মজহারের আমেরিকা পলায়ন, সালেহার সঙ্গে স্বামীর পুনর্মিলন এসবের সঙ্গে বোধ হয় হুমায়ুনের মৃত্যুর একটা সম্পর্ক জড়িত রয়েছে। লিংক- "http://www.facebook.com/note.php?note_id=94343956157&ref=mf
আহমদ ছফা আঁতকে উঠে এই গুরু মারা শিষ্য সম্পর্কে বলেছেন- ফরহাদ মজহার লোকটা সন্দেহজনক।

আমেরিকা পালিয়েছিলেন আরেক ছদ্মবেশী-সুবিধাবাদি সৈয়দ আলী আহসানের লেজ ধরে। সৈয়দ আলী আহসান সামরিক শাসক ও মৌলাবাদের চোঙ্গা ফুকাতেন। পাকস্তিান আমলে রবীন্দ্রবিরোধীতার পুরোধাঁ ছিলেন।

একাত্তরের পরাজিত শত্রু –ঘাতক জামায়াতে ইসলামী কিন্তু ফরহাদের এই কথাটাই বলে যে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ ছিল ভুল। ওটা ছিল ছিল ভায়ে ভায়ে দ্বন্দ্ব। ফরহাদ মজহার জামাতের কথাটা একটু আধুনিক ভাষায় কয়েছেন মাত্র। জামায়াত বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের শ্রষ্টা ও মদদদাতা। এই জঙ্গীরা যখন সারা দেশে বোমাবাজি করেছে- তখন জামায়াতের আমীর বললেন- এই বোমাবাজি আসলে র এবং মোশাদের কাজকারবার। তাকে যখন প্রশ্ন করা হল- এ তথ্য কোথায় পেয়েছেন ? তখন নিজামী সাহেব বলে দিলেন কমরেড ফরহাদ মজহার এটা লিখেছেন। জামায়াতের তথ্য প্রণেতা হলেন ফরহাদ মজহার! জঙ্গিদের কর্মকাণ্ডকে তিনি ‘সন্ত্রাসী’ বলতে নারাজ। সে সময় জঙ্গীরা বিচাররকদের বোমা মেরে হত্যা করেছে। আর ফরহাদ মজহার এই হত্যাকারীদের সাফাই গেয়ে লিখেছেন- ‘নিজেদের জীবন ও জীবিকা রক্ষা করবার যে কোন লড়াই-সংগ্রামকে এখন অনায়াসেই ‘সন্ত্রাসী’ কর্মকাণ্ড হিশাবে আখ্যায়িত করা সহজ। আমরা তো চোখের সামনেই দেখছি আদালত মানুষের মানবাধিকার রক্ষা করছে না।’

বিগত নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সারা দেশে প্রবল জনমত গড়ে ওঠে। সে সময় ফরহাদ মজহার ছিলেন বিএনপি-জামায়াত জোটের নির্বাচনী প্রচারের কর্মকর্তা। জঙ্গীবাদি সংগঠন হিজবুত তাহরীর একজন নেতা হলেন এই ‘সর্ব শ্রেষ্ঠ জীবিত বাঙালি কবি ফরহাদ মজহার। হিজবুৎ তাহরী এখন বাংলাদেশে একটি নিষিদ্ধ সংগঠন। জামায়াতের পত্রিকা দৈনিক নয়া দিগন্তের নিয়নিত লেখক হলেন ফরহাদ মজহার।

আর চিন্তাবিদ? রবীন্দ্রনাথকে অতিশয় হিন্দু এবং জমিদার বলে গালিগালাজ দিয়ে নিজেই রবীন্দ্র মজহার হতে গিয়ে ফেইল। কেউ তাকে পোছে না। তাই রেগে মেগে হতাশ হয়ে বললেন, নাহ, রবীন্দ্রনাথকে এড়ানো গেল না। তারপর তিনি লালন শাহকে রবীন্দ্রনাথের বিপরীতে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন। করে নিজেই জীবিত সুফি উপাধি ধারণ করলেন। আর তার দল হিজবুত তাহরির যখন লালন ভাস্কর্য ভাঙতে লেগে গেল তখন এই সুফি চিন্তাবিদ টু শব্দটি করলেন না। বললেন, লালন ছিলেন কুতার্কিক। এই হল চিন্তার শ্রেষ্ঠ চিন্তার নমুণা।

ফরহাদ মজহারকে নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই মঙ্গল। তার রয়েছে মৌলবাদিদের টাকা, জামায়াত-বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতা, এনজিওর নামে মেরে দেওয়া বিদেশী অর্থ, বিপুল ব্যবসা বানিজ্য এবং গাড়ি-বাড়ি-নারী…। এবং কতিপয় ভাড়াতে পেশীবাজি মাস্তান-লেখক। এবং আন্তর্জাতিক কানেকশন। অধুনা পশ্চিম বঙ্গেও এরকম একটি কানেকশন তিনি দাঁড় করিয়েছেন বলে শোনা যায়।

ফরহাদের দায়িত্ব হল- তরুণ বুদ্ধিজীবীদের মগজ ধোলাই করা। তাদেরকে বলা যে-‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা, চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ করা, একদলীয় শাসন কায়েম ইত্যাদি নানান রাজনৈতিক নির্যাতন ও নিবর্তনমূলক শাসনের কারণে বাকশালী আমল ফ্যাসিবাদী আমল বলে গণ্য হয়।‘ বাকশাল বলতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকেও নির্দেশ করেন। বাকশাল বলাটা তার বাককৌশল। তার ভয়াবহতম প্রকল্প হল- বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানী ধারণায় সাম্প্রদায়িকীকরণ। জনাব ব্রাত্য রাইসু এন্ড গং প্রত্যক্ষভাবে এই দায়িত্ব পালন করছেন। ফরহাদ তরুণ প্রজন্মকে জামায়াতের প্রতি সহানুবূতিশীল করেগড়ে তুলতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখান দেখা যাচ্ছে- তরুণ প্রজন্ম তাকে বুড়োর আঙুল দেখিয়ে দিয়েছে। জনগণ তার আদর্শের দল জামায়াত-বিএনপি'কে বিদায় করে দিয়েছে।

তাহলে পশ্চিম বঙ্গের কবি গৌতম চৌধুরী এইসব না জেনেই বলে ফেললেন- ‘ফরহাদ মজহার হলেন জীবিত বাঙালি শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে একজন। ফরহাদ মজহার হলেন বিভাগোত্তর বাঙালি জাতির একজন শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ’। বিষয়টা কি?
এক বন্ধু শুনে বললেন- ফরহাদ মজহার কবি! তাঁর কবিতা কে পড়ে এই বাংলাদেশে? তার কবিতা কি শ্রেষ্ঠ মানের কবিতা এবং জনপ্রিয় কবিতা? উত্তর শুনে পুরান ঢাকার ঘোড়াও হেসে উঠবে।

এখন গৌতম চৌধুরী এই একাত্তরের খুনীদের মুখোশ ফরহাদ মজহারকে শ্রেষ্ঠত্বের সার্টিফিকেট কেন দিলেন? পারলে ফরহাদ মজহারতো তার ঈমানী বাহিনী নিয়ে পশ্চিম বঙ্গের দাদাদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আর তার পক্ষে গৌতম চৌধুরী! ফেসবুকে দেখেছি- গৌতম চৌধুরী পশ্চিম বঙ্গের এক কবির কবিতার পোস্ট দিয়েছেন। এর আগে তার নাম শুনিনি। না শোনাটা আমার অন্যায় নয়। পাঠক হিসাবে আমি দুর্বল। কিছুদিন আগে কবি রণজিৎ দাশ ফরহাদ মজহারের অন্যতম স্বজন সাজ্জাদ শরীফের সঙ্গে ফরহাদীয় শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলন করেছেন। কবি জয়দেব বসু জানুয়ারি মাসে সগৌতম চৌধুরী বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছেন। তাদেরকে বাংলাদেশে নিয়ে গিয়েছিলেন অগ্রবীজের অন্যতম সম্পাদক মার্কিন মুলুকের সৌম্য দাশগুপ্ত। ভিডিওতে দেখেছি কবি ফরিদ কবিরের সঙ্গে আছেন গৌতম চৌধুরী। ফরিদ কবির সাজ্জাদ শরীফের আপন ভাই। ফরহাদ মজহারের লোকজনের সঙ্গে বাংলাদেশে তারা ফরহাদীয় নানা কিসিমের আয়োজনে ছিলেন। থাকুন- এটা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যখন এরা ছদ্ম বুদ্ধিজীবী মৌলবাদিদের সার্টিফিকেট দেন- তখন কিন্তু মাথা ব্যথা হয়। মাথার ভিতরে সেই পুরানো পাখি বলে ওঠে- এরা ভাড়াটে। এদের অনেকেই পশ্চিম বঙ্গে আছেন অভাবে-স্বভাবে। বাংলাদেশের কেউ ইশারা করলেই নাচতে নাচতে তারা এসে পড়ছেন। বাহ্যজ্ঞান শুন্য দশায় যা বলতে বলছে তাদের ভাড়াকারী বুদ্ধিবৃত্তিক মৌলবাদিচক্র- তারা তা অবলীলায় হড়বড় করে উগরে দিচ্ছেন।

কী বলেন পশ্চিম বঙ্গের কবি গৌতম চৌধুরী?

কোথাও মায়া লাগিয়া রহিয়াছে

লিখে লাভ কি?
এই প্রশ্নটি মাঝে মাঝে ভাবি। ভাবি, লেখাটি না হলে কী ক্ষতি হত!

আমি একটি গাছের নিচে দাঁড়াই। গাছটির পাতা নাই। গান নাই। বাকলগুলো তীব্র শীতে ফেটে গেছে। ফাঁকে ফোঁকরে তুষার জমে আছে। গাছটিকে প্রশ্ন করি, ও গাছ- গাছ হয়ে তোমার লাভ কি?
গাছটি কিছু বলে না। একটি কাঠবিড়ালি সুড় সুড় করে বাকল বেয়ে উপরে উঠে যায়। আবার নেমে আসে। পিটপিট করে তাকায়। গাছের ফোঁকরে ঢুকে পড়ে। হারিয়ে যায়। এই ফোঁকরটি না থাকলে কি ক্ষতি হত?

এইসব গুহ্য তত্ত্ব। তত্ত্ব এলে মাথা তপ্ত হয়ে ওঠে। হাসফাঁস করি। সামনের পুকুরটির উপর কে জানি সাদা রং ঢেলে গেছে। রোদ পড়ে চিকচিক করছে। কয়েকটি হাঁস ভেসে বেড়ায় এইখানে । আজ হাঁসগুলি নেই। থৈ থে জলে মাছ ধরতে ভাল লাগে। ঝুঁকে দেখি, কয়েকটি পালক পুকুরে আধখানি ঢুবে আছে। বলছে, আয় না। আয়। একটু একটু করে পা বাড়াই। কাঁপতে কাঁপতে বাম পাটি রাখি জলের উপরে। সাদার উপরে। ভাবি, এইবার ডুবে যাব। ডুবে গেলে কী ক্ষতি? কী লাভ মাটি উপরে দাঁড়িয়ে থেকে! আকাশ দেখা? তারার আলোতে ব্যাকুল হয়ে ওঠা। নেত্রজল মেলে দেওয়া। কোথাও মায়া লাগিয়া রহিয়াছে।

এইসব ভাবলে জলের উপরে হাঁটা যায়। হেঁটে হেঁটে পালকের গায়ে হাত রাখি। কান পাতি। এইখানে কোথাও মাছ ছিল। এখন নেই। মাছ- আমাদের হৃদয়ের মৎসকুমারী বোন- তোমরা এখন কোথায়? হাহাকার করতে করতে আমি জলের উপর দিয়ে ছুটে বেড়াই। ক্লান্ত হয়ে জলের উপর বসে পড়ি। জলকে জলের মত ভেবেছি। পদ্মপাতায় জলদেবী বসে। জল, তুমি জল হলে না কেন?


২.
বহুদিন আগে একটি উপন্যাস পড়েছিলাম। পূর্ণেন্দু পত্রীর। নাম মনে নেই। সেখানে শালতি বেয়ে লোকজন চলাচল করে। জলের উপর ছপ ছপ শব্দ হয়। বহুদিন আমিও শালতি বেয়ে চলে গেছি বহুদূরে। ফিসফিস করে পত্রীকে বলেছি, ওকে ডেকে দাও। মালতীদিদির কাছে যাব। মেয়েটির নাম কি মালতিদিদি? অথবা মাধবী? এইসব মনে নেই। মালতিদিদির শালতির কথা মনে আছে। আর ছোট ছোট ঢেউয়ের মর্মগুলি।

নিশিকুটুম্ব পড়ে মনোজ বসু হয়ে উঠেছিলেন আমার বাড়ির দাদা। এই দাদাটি বলছেন সাহেবের কথা। সারারাত্রি ভর সাহেব ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘর থেকে ঘরে। অদ্ভুৎ মেদুর ছোঁয়ায় তার হাতে উঠে আসছে সদ্য বিবাহিত নায়রী মেয়েটির সোনার হারটি, নাকফুল। অথবা কানপাশাটি। ভোরের আলোয় নৌকাটি চলে যাচ্ছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। সাহেব ঘুমিয়ে আছে। শান্ত ঘুম। এই নৌকাটির ছায়া আমাদের চোখের উপরে লেখে আছে। বাতাসের আগে ছুটে চলে। ধরার বাইরে। ছোঁয়ার বাইরে।

ডিঙি নাওটিতে বহুবার উঠেছি। তখনো ভোর হয়নি। ন'মামা বলছে, কেউ ডাকলে সাড়া দিবি না। কে ডাকবে? শুনছি ছোট ছোট শব্দ। কোচের ফলাটির। আর ডিঙির গুরার ফাঁকে জমে উঠছে লবটুলি মাছ।
আমার ডিঙি নাওটি-ই কি কোষা নাও?


৩.
একজন বুড়ো লোক সখ করে কোষা নাওটি বানাচ্ছেন। আর তার নাতিপুতি সুপুরির খোলে চড়ে খেলছে ধুলোর ভিতরে। আর মাঝে মাঝে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে কখন নাওটি জলে ভাসবে। বুড়ো লোকটির কোষা নাওটি পূর্ণ হয়েছে বটে- তবে আলকাতরা লেপার পয়সাটি নেই। গাবের কষ মাখা হল তো জলে ভাসানোর বাতাসা কবে আসবে এই নিয়ে অনেক যত্নের অপেক্ষা আছে। যেদিন বাতাসা এল- আমরা দেখতে পাচ্ছি- কোষাটি জলে ভাসছে। লগি ধরেছেন বুড়ো দাদাজান। আর চড়ে বসেছে কয়েকজন আমরা মানুষ। এরা ভাসতে ভাসতে শাপলা তুলছে। সূর্য ডুবে যাচ্ছে। অন্ধকার ঘিরে আসছে। এ অন্ধকার না এলে কী ক্ষতি হত? তবু অন্ধকার এসেছে। আমরা মানুষের মধ্যে একটি বালককে দেখতে পাচ্ছি- জলের উপরে হাত রেখেছে। রাখতে রাখতে সেও জলের মত শান্ত হয়ে গেছে। খুব শান্ত। এই চন্দন নামের বালকটি আর কখনো ফিরে আসেনি কোষাটিতে। কিন্তু বারবার ফিরে এসেছে আমাদের মনে। দাদাজানের মনে। আর তাই স্তব্দ হয়ে গেল সকলের জলে ভাসা। জলের মত ঘুরে ঘুরে কথা বলা।
আবার একদিন দাদাজান আমাদের ডেকে নিলেন। দেখতে পাচ্ছি তিনি কোষাটিকে ভাসিয়েছেন জলে। আলোর মধ্যে দিয়ে। অন্ধকারের ভিতর দিয়ে। আর ভাসিয়ে দিয়েছেন সেই আমাদের বাইরে চলে যাওয়া চন্দনকে। ছোট ছোট হাহাকারকে। আমরা এই কোষাটির সঙ্গে ভাসতে ভাসতে বুঝতে পারি- কোথাও মায়া লেগে আছে।

৪. শাদামাটা গল্পটি। নিরাভরণ বর্ণনা। কোথাও কোন গল্প জেগে ওঠে না। গল্পের কোন সম্ভাবনাও উঁকি দেখা যায় না। একটি গল্পহীনতার মধ্য দিয়ে আমদের নির্বান্ধব যাত্রা শুরু হয়। কেউ কোথাও নেই। বুঝতে পারি- গল্প ভেঙে দেওয়ার যাদু আমাদের মাথার ভিতরে নীলকণ্ঠ পাখির মত ডাক দিয়ে যাচ্ছে। সাই সাই করে। কোন এক সম্ভাবনার অসীম আকাশে। জল রঙের মত। অস্পষ্ট। রহস্যময়। অপার। প্রাণের মত সৌম্য। নিখিল। তাকে কে এড়াবে এখন?

এই গল্পটি পাপড়ি রহমানের। নাম কোষা। এই না-গল্পের গল্পগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে এবারের বইমেলায় ধূলিচিত্রিত দৃশ্যাবলি। ধুলি সরিয়ে সরিয়ে এই দৃশ্যাবলি পড়তে পড়তে ভাবি, কী লাভ হত গল্পটি না লিখে? না ভেবে! জলকে জলের মত না ভেবে!


........................
ধূলিচিত্রিত দৃশ্যাবলি
পাপড়ি রহমান
আমার প্রকাশনী

জহির রায়হান : অন্তর্ধান বিষয়ে ১৯৭২ সালের একটি লেখা

সাংবাদিক পার্থ চট্টোপাধ্যায় জহির রায়হানের সঙ্গে দেখা করেন তাঁদের কায়েৎটুলির বাসায়। ১৩ ডিসেম্বর তার অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারকে দুপুরবেলা আল বদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। ১৪ ডিসেম্বর তাকে হত্যা করা হয়। বাড়ির প্রত্যেকের মত জহির রায়হানও এ হত্যাকাণ্ডকে মেনে নিতে পারেননি। তিনি পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে বললেন, আমার বিশ্বাস দাদা এখনো বেঁচে আছেন। বউদিও তাই বিশ্বাস করেন। কিন্তু সম্ভব-অসম্ভব অনেক জায়গায়তো খোঁজাখুঁজি করছি--
-মৃতদেহ কি শনাক্ত করতে পারেননি?
--আন্দাজে শনাক্ত করা হয়েছে। ডেডবডিগুলো এমন বিকৃত হয়ে আছে যে কিছু বোঝা মুশকিল। তাই এখনো সকলের মনে ক্ষীণ আশা তিনি বেঁচে আছেন।
--কারা কারা এই ঘটনায় জড়িত কিছু ধরতে পারলেন?
--একজনকে পাওয়া গিয়েছে। সে স্বীকার করেছে যে সে কালপ্রিটদের চেনে। নামও বলেছে। কিন্তু তাদের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।

... এর কয়েকদিন পরে জহির রায়হান একটি ফোন পান। তাঁকে জানানো হয়, তাঁর দাদা শহীদুল্লাহ কায়সারকে মীরপুরে আটকে রাখা হয়েছে। তিনি মীরপুরে চলে যান। এরপর জহীর রায়হানকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেদিন ছিল ৩০ জানুয়ারি, ১৯৭২।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, জহির রায়হান প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যে সাম্প্রদায়িক চক্র ঢাকার বুদ্ধিজীবী হত্যার পিছনে দায়ী তাদের তিনি নির্মূল করবেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ঢাকায় বুদ্ধিজীবী নিধন অনুসন্ধান কমিটি স্থাপন করেন। কমিটির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন, 'হলিডে' কাগজের সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান।
এই বুদ্ধিজীবী অনুসন্ধান কমিটির অফিস হয়েছিল ঢাকা প্রেসক্লাবে।

জহির একদিন আমাকে বলেছিলেন, প্রেস ক্লাবে আসুন। বহু চাঞ্চল্যকর তথ্য উদ্ধার করেছি। আপনাকে দেখাব।
আমি বলেছিলাম, এখন কি আর কাউকে খুজে পাবেন? এসব পণ্ডশ্রম হচ্ছে আপনার। আর তা ছাড়া স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে। আর তারা কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। যা মারা গেছে তাকে কেন আবার খুঁচিয়ে তুলবেন।
জহির বলেছিলেন, এখানে আপনার সঙ্গে আমি একমত নই। যারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী তারা সাময়িকভাবে গা ঢাকা দিয়েছে বটে, কিন্তু তারা বাইরে কোথাও যায়নি। এই দেশেই আছে। আবার ঐক্যবদ্ধ হতে চেষ্টা করছে। আপনি ভাববেন না, সাম্প্রদায়িক শক্তি চিরদিনে মতো খতম হয়ে গিয়েছে।
জহির বলেছিলেন, আপনাকে আমি ওদের গোপন লিফলেট দেখাব। তাতে ওরা লিখেছে, আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়নি--সবে শুরু। আপনি প্রেসক্লাবে আসবেন, বহু দলিল দেখাব।
নামধাম ঠিকানা সব পেয়েছি--তাদের কিছুতেই নিষ্কৃতি দেওয়া হবে না--আই স্যাল ফাইট আনটু দি লাস্ট।


প্রেসক্লাবে গিয়েছিলাম নির্ধারিত সময়ে। কিন্তু যথারীতি জহির সেদিনও কথা রাখেননি। আলাপ হল এনায়েতুল্লাহর সঙ্গে। আমাকে বললেন, কাগজপত্র সবতো জহিরের কাছ।...
সাম্প্রদায়িক চক্র সম্পর্কে জহির রায়হান বহু তথ্য উদ্ধার করেছিলেন। এ কাজেই তার কাল হল। তিনিও নিখোঁজ হলেন। ম্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের হাতে তাদের সবচেয়ে বড়ো শত্রুর জীবন এভাবেই শেষ হয়ে গেল।''

জামায়াতের পত্রিকা দৈনিক নয়া দিগন্ত আর দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবস উপলক্ষ্যে নিবন্ধ ছেপেছে। সেখানে তারা বলার চেষ্টা করেছে- জহির রায়হানের হত্যাকাণ্ডের পেছনে তৎকালীন আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র ছিল এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় তাকে শেষ করে দেওয়া হয়। এমনকি তারা বঙ্গবন্ধুকেও তারা দায়ী করার চেষ্টা করেছে। জামায়াতের এই অপপ্রচারের জবাবে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের লেখাটি পড়ে মনে হল, সব সত্যকে চাপা দেওয়া যায় না। অনেক সৎ দলিল রয়ে গেছে ঘাতকদের সমুচিৎ জবাব দেওয়ার জন্য। সেগুলো খুঁজে বের করা দরকার।

নোট :
সাংবাদিক পার্থ চট্টোপাধ্যায় ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ঢাকা পৌঁছান। তারপর পাঁচমাস তিনি ঢাকায় থেকে যান। সেই সময়কার লেখা ডেটলাইন ঢাকা নামে উল্টোরথ পত্রিকায় সেসময় ছাপা হয়েছিল। পরে ২০০৪ সালে পুনশ্চ প্রকাশন, ৯এ, নবীন কুণ্ডু লেন, কলকাতা থেকে বই আকারে বের হয়।

.................................
সাংবাদিকের ডায়েরি
পার্থ চট্টোপাধ্যায়
মূল্য ১৫০ টাকা

গল্প লেখার গল্পটি

আমাকে বিপদে ফেলেছেন তিনজন। ডোবার ব্যাঙ, অমি রহমান পিয়াল এবং নুরুজ্জামান মানিক।
এদের কাউকে আমি চিনি না। চেনার কথা নয়। আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরছি। নদীতে নদীতে কাটিয়েছি। গাছপালার চিকিৎসাকর্ম কিছু জানা ছিল। লেখালেখির জগৎ নিয়ে কোন মাথাব্যথা ছিল না। এই লেখালেখি আমাকে খেল।

আমি শুদ্রবংশের ছেলে। টুকটাক লেখাপড়া আর বাপের ক্ষুদ্র ব্যবসাতি নিয়ে দিন কেটেছে। ১০০% জন্ম গৃহহীন। সেজন্য বিপ্লবের প্রতি ভরসা ছিল। বিপ্লব এলে সত্যিকারের মাথাগোজার ঠাঁই পাব। এই বিপ্লব ব্যাটাই আমাদের চোখের সামনে থেকে নাই হয়ে গেল। বার্লিন কোন সুদূরের দেশে। সেখানে একটি দেয়াল ভেঙে পড়ল। আর আমাদের বাংলাদেশের গণ্ডগ্রামের কয়েকটি হৃদয় তার নিচে চাপা পড়ল। সে রক্তপাত এখনো চলছে। হায়, ভ্লাদিমি ইলিস, তুমি কোথায়? তুমি অভিশপ্ত হও।

কবিতা লিখে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছিলাম। নদী নিয়ে কবিতাটি লেখা। ‘নদী মরে গেলে সত্য হারিয়ে যায়’। সেটা ১৯৮৪ সালের ঘটনা। এটাকে কবি মোহাম্মদ রফিক আর নির্মলেন্দু গুণ আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক উৎসবের সেরা কবিতা নির্বাচন করেছিলেন। কয়েকজন কবিজনোচিত লোকজন আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখলেন। আর বললেন, ধুস, একে দিয়ে হবে না। এ শালা গাজা খায় না। মদ খায় না। চা-ও খায় না। রাত বিরেতে হল্লা করে না। নদী টদি নিয়ে কবিতা লেখে। বাতিল।
আমি ভাই রোগাপটকা মানুষ। পকেটের চেহারা আরও খারাপ। দিন কেটে যায় একা একা। আধা খেয়ে- সাধা খেয়ে। এ রকম না খাওয়া পার্টির সঙ্গে দুএকবার সায়ংকালে ঘুরে ফিরে মাথার গোঁজার ঠাঁই হল। পরে দেখি- এরা স্টার সিগারেট টানে। আর বসে বসে ঝিমোয়। মাঝে মাঝে দুএকজন ডিম ভাজি খায়। খেতে খেতে তাদের বাড়ির সিংহ দরোজার গল্প করে। এখানে আমার মতো নাই-বাড়ির লোকজন খুবই অচল।

একটি মেয়ে একদিন আমাকে বলল, তুমি কবিতা লেখ?
আমি কিছু বলার আগেই নেতা ওকে ইশারা করে ডাকলেন। মার্কস এঙ্গেল আউড়ে বললেন, ওর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। ও বিপ্লবের অচল মাল।
কিন্তু আমি তো সত্যি সত্যি বিপ্লবকে ভালবাসতাম। বিপ্লব এলে আমার জননী যে তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালে সেটা সত্যি আমার মায়ের হত। কেউ বলতে পারত না, এটা তোমাদের বাড়ি নয়। তোমরা সর্বহারা। আহা, বিপ্লব, তুমি কেন রেড স্কোয়ারে মুখ থুবড়ে পড়লে? কমরেড ফরহাদ, তোমার নামে প্রদীপগুলো নিভে যাক।

আমি তখন কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে লোকজনের ফাইফরমাস খাটতে শুরু করেছি। এর মধ্যে এই সব ঝিম মারা বিপ্লবীরা কোন ফাঁকে আমার নামে একটা পোস্টার সেঁটে দিল- কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক পদে এই গোবেচারাকে ভোট দিন। আমি এসব জানতেই পারিনি। আমি তখন মধুপুরের জলছত্রে। কুষ্ঠ আশ্রমের পাদ্রী মহাশয়দের সঙ্গে ঈশ্বরের বাক্য পাঠ করছি- আর প্রভুর দুই নম্বর মেষ হয়ে ফ্রি খাওয়া খাচ্ছি। কারা কারা যেন যথাযোগ্য লোক না পেয়ে আমার মতো গোবেচারাকে সিল পিটিয়ে দিল। ভোটগুলো জলে পড়েছে। ছাত্র সংসদ যে আগামী দিনের ঘড়ের মাল তৈরির কারখানা এটা বুঝতে আমার সময় লাগল না। সদাপ্রভু আমাকে রক্ষা করলেন। ওরা বলল, এই লোকটা চাঁদাবাজি ছাড়া বিপ্লব করতে চায়। হা হা হা। বেঁচে থাকুক তাহাদের এই হা হা হা।

কিছুদিন পরে একজন প্রফেসর জিজ্ঞেস করলেন, বৎস, তুমি এই নিউটনী কোটখানা কোথায় পাইয়াছ?
বলিলাম, আমার সঞ্জীব দিয়াছে।
-এই শার্টিটি কাহার?
-বাতেনের।
-এই ঢলঢলে প্যান্টটি?
-কোনো মাদামোয়াজেলের নহে আর্যে। উহাও একজন বন্ধু মাসুদের। তিনি কিঞ্চিৎ ফাউভোজী।
-মোকাসিনটি?
-মুচির দোকান হইতে ভাড়া লইয়াছি। দৈনিক পাঁচসিকা।
-মার দিয়া কেল্লা। প্রিয় ভদ্রে, তোমার প্রিয় কর্ম কি?
-ঝিমানো।
তিনি রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, পারফেক্ট। সিভিল সার্ভিসের জন্য ইহার যোগ্য আর কেহ নাহি। যাও বেটা। উপজেলাজেলায় যাও। ঘাস কাটো।

আমি দীর্ঘ পনেরটি বছর গ্রমে গ্রামে ঘাস কেটে বেড়িয়েছি। এই ঘাসের বর্ণ আমার মর্মে গেঁথে গেল। আহা আর্যে, প্রফেসর এবিসিডি আপনার টাকে অতি সুচিক্কন ঘাস গজাক।

গজানোর আগেই সদাপ্রভু তার এই নাদান মেষশাবককে প্লেনে তুলে দিলেন। কহিলেন, ওহে বৎস, নয়ন মেলিয়া দ্যাখো- হুই যে হাডসন নদী। ইহার ভিতরে আমি হস্ত উত্তোলনপূর্বক দণ্ডায়মান হইয়া স্বপ্ন বিতরণ করিতেছি। চাহিবামাত্র বাহককে দিতে বাধ্য থাকিব।
স্বপ্ন দূর থেকে দেখা ভাল। কাছে গেলেই বিপদ। স্বপ্নকে দেখে বড় বিস্মিত হলাম। বিস্ময় ভাঙতে সোজা হাসপাতালে। ডাক্তার ধীরে ধীরে আমার কানে কানে কহিলের, প্রিয় বয়স্য, অচেতনে কি কহিয়াছ একটু বুঝাইয়া কহিবে কি? তিনি একটি টিপ রেকর্ডার চালাইয়া দিলেন। শুনি, কোন এক আমি কহিতেছি- রূপ নারাণের কূলে জেগে উঠিলাম। জানিলাম এ জগৎ স্বপ্ন নয়। সত্য যে কঠিন। কঠিনেরে ভালবাসিলাম। ডাক্তার অনেক কষ্টে এই কথাগুলি অনুবাদ করে তার দরোজায় টানিয়ে দিলেন। নিচে লিখেছেন আমার নাম। আঁতকে উঠলাম। বললাম, বেটা ভগুচগু, ওটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা।
রভীন-ড্রন- নাট? উহাকে চিনি না। যে ব্যাটার নাম খটোমটো তাহাকে আমার দরকার নাই।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে আমার দরকার। জীবনের প্রতি পদে পদে দরকার। আকণ্ঠ যন্ত্রণায় ডুবে তিনি আনন্দ ছেঁকে এনেছেন। এ লোকটাই আমাকে বুঝেছেন।

এই সময় আমি হাঁটতে ভুলে গেলাম। খাওয়া দাওয়া ঘুম- বিলকুল গায়েব। কোথাও কোন ক্রন্দন নেই। শুধু আমার ভিতরে আছে। সেকি বাঁচার জন্য? না, মরে যাওয়ার জন্য –জানি না। শুধু জানি মাঝে মাঝে আমি মরে যেতাম। ডাক্তার তখন বলতেন, প্রিয় বয়স্য, দ্যাখো- তোমার মেয়েদের চেয়ে দ্যাখো। আমি তখন বেঁচে উঠতাম।
আমার মেয়ে দুটি শান্ত। ডাল খায়। ভাত খায়। ছোট মেয়েটি বলল, জানো বাবা, ক্যান্ডি খেতে আমার ভাল লাগে না। দাঁত নষ্ট হয়। বড়োটি নভেল লেখা শুরু করল। পাঁচশত পৃষ্ঠা লিখবে। এই ঢাউস নভেল প্রকাশিত হলে প্রকাশক অনেক ডলার দেবে। ডলার ছাড়া সংসার অচল। ঠিক এ সময় আমার স্ত্রী চাকরী হারাল।

আমি ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করেছি। হেঁটে হেঁটে কাজে যাই। দেখতে পাই- আমি একা নই। দুইজন লোক। একজন অসীম যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। পিছন থেকে আরেকজন কানের কাছে বলেই যাচ্ছে- থেমো না। হাঁটো। হাঁটতে থাকো। সামনের মানুষটি আমি। পিছনের মানুষটিও আমি। দুজনেই ক্লান্ত। শ্রান্ত। অবসন্ন।


এইসব দিনে অনন্ত দুঃখের মধ্যে আমি একটি অক্ষর লিখি। লিখি দুটি অক্ষর। কাঁপতে কাঁপতে লিখি একটি শব্দ। পূর্ণ একটি বাক্য। মরে যেতে যেতে লিখি একটি পাতা। এক পাতার গল্প। দীর্ঘশ্বাসের। বেদনার।আর হাহাকারের।
কেন জানি ডোবার ব্যাঙ আরেকটি গল্পের আবদার করে বসলেন। তার ভঙ্গিটি আমাকে আরেকটি গল্প লেখাল। ডাক্তার দেখেশুনে বললেন, ওকে। চালিয়ে যাও। থেম না। আমার মেয়ে দুটি আমার পাশে বসে লিখতে শুরু করে দিল। লিখতে লিখতে বলল, বাবা, লেখ বাবা।
লিখতে লিখতে দেখি, আমাকেই লিখছি। লেখার মধ্যে দিয়ে কোন এক আমি উঠে আসছে। ছেঁড়া খোঁড়া। পরাজিত। শুদ্র মানুষ। গৃহহীন মানুষ।

অমি রহমান পিয়াল উস্কে দিয়ে বললেন, একাত্তরকে নিয়ে লিখুন। বাহাত্তরকে নিয়ে লিখুন। পচাত্তরকে নিয়ে লিখুন।
এগুলোতো লিখছেন অমি রহমান পিয়াল। নূরুজ্জামান মানিক। ওদের লেখার মধ্যে দিয়ে ইতিহাস কানাগলি থেকে বেরিয়ে আসছে। অণ্ধকারের ভিতর থেকে ভাঙাচোরা আলো ফিরে আসছে। পথ দেখতে পাচ্ছি।

এই পথ দেখতে পাওয়াটা বিপদ। পথ জানা থাকলে আবারো বিপ্লবের ফেরার সম্ভাবনা জাগে। আবার মনে মনে আশা জেগে ওঠে- আমার মায়ের তুলসী তলাটি ফেরত পাওয়া দরকার, যেটি তার নিজের। কেউ তাকে বলবে না, তোমার কিছু নেই। শূন্য।

হায় শূন্যতা, তুমি আর কতকাল রহিবে আমাদের ঘাড়ে?

...................
কাকমানুষের চকখড়ি
গল্পগ্রন্থ
প্রকাশক : আমার প্রকাশনী।

স্টাইল নিয়ে কিছু কথা

আন্তন চেকভ একটি চিঠি লিখেছিলেন গোর্কিকে। বলেছিলে--'তুমি একজন আর্টিস্ট। তোমার অনুভব-ক্ষমতা অসাধারণ; তোমার কাছে অনুভূতি আকার পায়। যখন তুমি একটি বস্তুর বর্ণনা দেবে, তখন তুমি যেন তা দেখতে পারো আর হাত দিয়ে ছুঁতে পারো। এই হবে যথার্থ লেখা।'

ভাষা হবে লেখকের ক্রীতদাস, আদেশ মাত্রেই তা কার্য সমাধা করবে, লেখকের অনুভূতি বা চিন্তাকে সাকার রূপ দেবে। এখানেই লেখার স্টাইলের চরম সার্থকতা। এরই জন্য লেখক দিনের পর দিন সাধনা করেন।
যে-কোনো গদ্যরচনা বা কবিতায় লেখক ব্যক্তিত্বের এমন-সব গুণ ও বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়, যেগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখানো যায় না, অথচ অনুভব করা যায়, এবং সেইসব গুণের যোগফল লেখক-ব্যক্তিত্ব, এমত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, তাকে এক কথায় বলা যায়- স্টাইল।
স্টাইল হচ্ছে লেখক মানুষটি।

ফ্লোব্যের বলেছেন, স্টাইল হচ্ছে লেখকের বিভিন্ন বস্তুকে দেখার বা চিন্তা করার একান্ত নিজস্ব ভঙ্গি। স্টাইল ভাষার এমন একটি গুণ যা লেখকের বিশিষ্ট চিন্তা-ভাবনা-অনুভূতিকে অব্যর্থভাবে যথার্থ্যের সঙ্গে পাঠকমনে পৌঁছে দেয়। পাঠকমনের সঙ্গে লেখকের যোগাযোগের সেতু। শব্দ, বাক্য, চিত্রকল্প, অলংকারের অবরণ-মণ্ডিত যে লেখক-ব্যক্তিত্ব, তারই নাম স্টাইল। তা ব্যক্তির পোষাক নয়, তার রক্ত মাংস আর হাড়।

স্টাইলের ছয়টি গুণ :
স্বচ্ছতা, সরলতা, পরিমিতি, বৈচিত্র্য, নাগরিকতা ও সরসতা।

মনোভাব প্রকাশেই ভাষার সার্থকতা। একজন অন্যজনের কাছে তার মনোভাব প্রকাশে ভাষার সাহায্য গ্রহণ করে। স্বভাবতই ভাষা যত স্বচ্ছ হবে স্পষ্ট হবে, মনোভাব ততই স্পষ্ট হবে।

বঙ্কিম চন্দ্র বলেছেন--যিনি সোজা কথায় আপনার মনের ভাব সহজে পাঠককে বোঝাতে পারেন তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক। লেখার উদ্ধেশ্য পাঠককে বোঝানো। এটা সরলতা।

অতিকথন বর্জন করে মিতভাষণে, অসংযত ভাবোচ্ছ্বাস বর্জন করে আত্মসংযত পরিমিত বক্তব্যে উপনীত হবার সাধনাই স্টাইলের সাধনা।
লেখায় বৈচিত্র্য থাকতে হবে। বৈচিত্র্যহীন তীক্ষ্ণাগ্র সংহত চিন্তাসমৃদ্ধ রচনা অনেক সময় পাঠকমনের এতবেশি মনোযোগ ও আনুগত্য দাবী করে যে রচনার মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়।

চিত্তবৃত্তির বাহুল্যবর্জিত আভিজাত্য, বুদ্ধিপ্রবণ মননশীলতা, যুক্তিধর্মিতা ও প্রাণের সজীবতা নাগরিকতা-গুণের লক্ষণ। এর বিপরীত কথা হচ্ছে গ্রাম্য বা অশ্লীলতা। যে কথা শুনে লজ্জা ঘৃণা অথবা অমঙ্গলের আশংকা উদয় হয়, সে বাক্যই অশ্লীল। সহৃদয় সামাজিকের (কালচার্ড মানুষ) মনে যদি লজ্জা বা ঘৃণার ভাব জন্মে, তবে উৎস যে রচনা, তা অশ্লীল, গ্রাম্য। গ্রাম্যতা হল- চিত্তের অনুদারতা, দৃষ্টির সংকীর্তনতা, যে কোন পরিবর্তনের প্রতি বিমুখতা, শ্রেষ্ঠাত্বাভিমান।

সরসতা গুণের জন্ম লেখকের সহাস্য রসিকতায়, উদার জীবনদৃষ্টিতে, জীবনসম্ভোগের আনন্দে। এই গুড হিউমার দেয় বা সরসতা লেখাকে দেয় স্বাদুতা, পাঠকের মন ভরে ওঠে এক অনাস্বাদিতপূর্ব আনন্দে। অসূয়া, ঈর্ষা, দ্বেষ, ঘৃণা, ক্রোধ, জুগুপ্সা এই সরসতার বিপরীত।

মলিয়েঁর তার কোন লেখা শেষ করেই তার রাধুঁনীকে পড়ে শোনাতেন। রাঁধুনিটি ছিল অশিক্ষিত। রাঁধুনীটি যদি হেসে উঠত তবে বুঝতেন লেখা ঠিক হয়েছে। সার্থক হয়েছে। তিনি কোনো পণ্ডিতের কাছে যেতেন না।


খুব দরকারী একটি বই কিনুন-
বাংলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাস
অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়

Friday, April 2, 2010

আমার কবি সত্ত্বা

ইদানীং মেজাজ বিগড়াচ্ছে খুব
অযথা তর্ক, গালাগালি অথবা বিতর্ক সভার আয়োজন,
বিদ্রূপের ঝাঁঝালো হাসি-
হিতাহিত জ্ঞানশুন্য মন্তব্য আর ভালো লাগেনা
মশা তাড়ানোর তো কৌশল আছে, তর্কের কৌশল নাই ?

টেবিল চাপড়ানো চিৎকার আর ভালো লাগেনা,
কিছু নীরবতা, কিছু নির্জনতা ছাড়া আর কী-বা চাইতে পারি ?
তুষারপাতের মতো মনের ভেতরে হীম শীতল আবহ
রাত্তির জুড়ে ঘুম নাই চোখে-

ফুটপাতে দাড়িয়ে ঝাল-মুড়ি আর ভাল লাগেনা,
কবিতার খাতায় শূন্যতা,
কলমগুলোতেও কালি নেই-
বাঁশঝাড়ের কোনে জমানো বাঁশপাতার ছাই
মাড়ানো সন্ধ্যার নিভুনিভু পিদিম-
ঠিক যেন আমার কবি সত্ত্বা ...

ভোরে রচিত কথাগুচ্ছ

সৈয়দ আফসার

বৃষ্টিরাতে স্বপ্নশ্বাসে যে কথা বলে, হাসে... ভোরে তার কথা বেশি মনে পড়ে যায় ঘোররাতে একাই লুকাই মুখ কাঁথাবালিশের তলে কেউ যদি পোড়ায়...ওদের বলিস, আমাকে না-জাগালে ক্ষতি নেই,শীতের দিনে শুতে যাবো না একা বিচানায়, না-বললে কি হয়... চোখের সৌন্দর্য অলৌকিক কিছু নয়; গুটিকয় উষ্ণতা না-ছুঁলে ক্ষতচিহ্ন গোনতে পারি,হোনতে পারি ছুটির দিনে কারও আনাগোনা; ভোরে যত দীর্ঘ স্বপ্ন দেখি চুলে বাঁধি না তারে; শুধু দেখে নিলেই হয়, কার নিঃশ্বাসে লুকানো সর্বশেষ বিষ্ময়!
♣♣
ছুঁতে যদি নাই পারো তাও ভালো, অপূর্ণ রাতে চাই না কামনা, তুমি কেঁদো না শেষ রাতে দু’চোখের পাতা; তোমারি জন্য অনিদ্রিত চোখে বিছানায় চলে হাঁটাহাঁটি। ব্যর্থ হলে ক্রন্দনকাকুতি করো না; তারচে’ ডাবু বোঝাই স্বপ্ন ঘষে রাখো খালি পকেট ... একাকি হলে আমার দিকে ছুঁড়ে দাও পুরনো ক্ষত আর ব্যর্থদিনলিপি;যদি বলি সকালের রোদে কারো ভাল নাও লাগতে পারে প্রকাশপ্রীতি; জানি তোমার ভাল লাগা আহা... রোদগাঁথা জানালার পাশে একা দাঁড়িয়ে থাকার গ্লানি, জানো তো আমরা আদিসূত্রে পাইনি কলঘরে ঝরনার পানি ডিশ্এন্টিনা-ষ্টারপ্লাস মুঠোফোনে কথা দাঁড়িয়ে থাকা...অবশিষ্ট চ্যানেল যত তাও ছুঁতে পারি; কিস্তু আমার তাকানোর নির্ধারিত কোন গতি নেই, যখন দৃশ্য দেখার ইচ্ছে করে দুঃখসব ভুলে ঘন্টার পর ঘন্টা দু’চোখ বন্ধ বসে থাকি, বুক থেকে চুষে নেই যত অনুতাপ দেহের প্রকৃতি
♣♣
তুমি যেতে পারো দূরে ঈর্ষার পাশে,অবশিষ্ট যত মিশেছে শ্বাসে;যদি চোখ থেকে নিদ্রা খুঁটে নেয় কেউ; যদি মায়াচোখে জড়াতে চায় রাত্রিঢেউ; এই বেলা তোমার আসা-যাওয়া অন্যপ্রকাশ দোষের কিছু নয়;চেষ্টা করে নিলে হয়, রহস্যঘেরা আমারি লালার পাশে দাঁড়নো তবে কার ঘুমের জরা? নিদ্রায় জাগিয়েছি লুকানো চুম্বন দেয়ালে-আয়নায় টাঙানো অন্ধ-বধিরতা।বলছি মাটি চুঁয়ে নামবে ভাবালুতা... তুমি যেতে পারো দূরে অন্যতা,ভাবনা সম্ভাবনা; জল গুনে গুনে কান্নার রস ঢেলে দিতে পারো কিন্তু পাশাপাশি বসে অভিশাপ দিতে পারো না
♣♣
যাবার রাস্তা চিনে সে যদি ফিরে যায়;তাকে একা যেতে দেবে পথিকের চেয়ে দূরে; তুমি থমকে দাঁড়াবে না ঘুরপথে; বাকিটা পথ পেরুলেই কাঁচা-পাকা রাস্তার পাশে ঠোকর দিচ্ছে পাথরের রোদ ঘরে ফেরার আগে উঠানে খাঁড়া পা-হাঁটা পথের গ্লানি,তারই ভেতর সকাল গড়িয়ে মধ্যদুপুর তুমি কি পিচ রাস্তায় ধরে শেষ বিকেলের দিকে হেঁটে যাবে;নাকি নিজেই নিজেকে ফিরিয়ে নেবে আলো বাতাসে মিশে;স্বেচ্ছায় আত্নহত্যা করবো না বলে আমি পথেই রয়ে যাবো; পথের পাশেই রবো চির নিদ্রায় শুয়ে। এরকম ধারণা তোমাকে কি কখনও তাড়ায়,বলে দাও ওহো ভোরের হাওয়ায়...
♣♣
তোর প্রস্থান ছাড়া জামার ভাঁজে লুকানো গুপ্তরত্নধন তার ভেতর যাওয়া-আসা দেহের পিপাসায় দশআঙুলে তরতাজা বৃষ্টিফুল;কাকে যে তাড়া করে ফুটিয়ে তুলছে চাঁপা-বকুল; হাত ধরে টানাটানি কেনো এতো পাগলামি প্রতিদিন; বহুদূরে জানালা খুলে খুলে তাকানো আর কতদিন,প্রকৃত সত্যটুকু তোর পেছনে লুকিয়েছে অলসতা টাটকা শীতের উষ্ণতা, সে কি জানে না;ওই হালকা-পাতলা জামার নীল বোতামের ফাঁকে আনমনে দুলছে কার কামনা
♣♣
যেটুকু চেয়েছো টোলহীন গালে, না-ছুঁলে বিশ্বাস করবে না; আর বুঝানোর ভাষা তুমিও জানো না! দুর্লভ-প্রেম। কখনো-কখনো মনে হয়্টানা-টানা দিনে আমাদের ফেলে আসা কথাগুলো হেসে-হেসে উড়িয়ে দিলে কিছুই জানলে না... দেখলে না কার ইশারায় দেয়ালে সাজানো অকাল বরষা! বৃষ্টিজল। কথা ছিল যে যাই করি মিলেমিশে হবে কিন্তু আজ দীর্ঘ বিরতির পর মনে হয় তোমার দু’চোখে একা ঘুমায়পুরোসমূদ্র নিজস্ব ঠিকানা
♣ ♣
পরে জেনেছি সংকোচ ছিল বলে ভালই ছিলাম, রান্না ঘরের পাশে; শুধু জানি দুঃখ কঠিন কিছু নয় অপেক্ষায় শ্বাসকষ্ট বাড়ে দীর্ঘশ্বাস ছুঁয়ে নিলে হৃদরোগ কমে; কিন্তু তুমি কি জানো দুঃখ আমার একার হবার কথা ছিল না, গোপন হৃদপিণ্ড কি কষ্টেই-না আছে; ইচ্ছে করলেই যে সব কিছু নিজের মতো করে ভাবি, তাও বলা যাবে না আর দুঃখটুঃখ কম পেলে জীবনের উপলব্দি মনে হয় জামা পরা... অন্য কিছু বলছি না; শীত রাতে জোড়াজুরি করো না কাঁথাবালিশমাথা

♣ ♣
তুই কি জানিস্ অনতিদূরে তাকানোর শেষ ইচ্ছা স্থির করে প্রথম যেদিন তোর সামনে দাঁড়ালাম মনে হলো এই বুঝি বেড়ে গেল চোখের জ্যোতি তোর নীরব উপস্থিতি আঁধার কী মানে, সন্ধ্যেবেলা চোখ বুজলেই আড়াল হয়ে যায় জীবনের একটি দিন কিন্তু মনের বয়স কখনো বাড়ে না;এ সত্যটুকু তোকে অত্যন্ত ভালোবাসে যাবে বয়স বাড়লে; তুইও জানিস্ পূর্বাকাশ ঘিরে থাকা সন্ধ্যে হাওয়ার ঘোরে আমরা যে হারিয়েছি শৈশবের কিছু কথা... কিছু উন্মাদনা; তাই বলে কি বরফের দিনে দূর্ভোগ সামনে দাঁড়াতে পারে না
♣ ♣
গত নয় বছরে স্বপ্ন দেখা ছাড়া কিছুই পাইনি; কোথায়ও যাওয়া হয়নি আর; তাড়া আমার আগ্রহটা কেনো যে উড়াতে চায় ঘন কুয়াশায়; তখন কেনো জানি মনে হয় দূরচক্রবালে তোমার মোহ ,নষ্ট কীটের চেয়েও ভাল;অপেক্ষার দিনে কিছুই ঘুচল না কেবল বেলা গড়িয়ে জীবনঘড়ি মধ্যদুপুরে ঠেকেছে; বিকেল সন্ধায় হারাবে সহসাই নিজেকে সামলাতে সামলাতে; তাই দেখে তুমি কিনা জটিল সব রোগে সুখ দাও,জানি না কেনো?কোথায় প্রতিশোধ রেখে; তোমার বাড়ি ফেরার টানে দু-বাড়ির মাঝখানে যত রহস্য ছিল চুপচাপ থেমে গেল আমাদের আ-ছোঁয়া স্বপ্নে মিশে
♣ ♣
এমন কিছুই ঘটেনি ফেরার টানে, ভাবছি না-ফেরার দিকে তাকিয়ে অবাক দৃষ্টি কি তোমার কাছে আশ্চর্য মনে হয়?এসব নিয়ে কিছুই ভাবিনা,ভাবনায় মাত্রা নেই বলে তোমার কি মনে হয়, তার কোনো মানে হয়? তুমি মাথা নাড়ালে কিছুই বললে না কিছু কী বলার প্রয়োজন আছে জিহ্বা নাড়িয়ে; তার চেয়ে ভাল বয়াম খুলে তুমি তেঁতুলের আচার খেতে পারো জল ঘুলিয়ে; যদি ঠোঁটের পাশে লেগে থাকে আচারের ঝাল; তবে সবই অতিসরল পানীয় ফল
♣ ♣
কোথায়ও যাওয়া হয় না-ফের ফিরে আসতে হয় বলে দৃষ্টি ছুঁয়ে শেষ প্রান্তে দাঁড়ায় না-কেউ ঝড়ো হাওয়ায় যাওয়া-আসার মধ্যে কিছু জয় পরাজয় থাকে কিছু পরাজয় জয়ের চেয়েও আনন্দ দেয়... আরো আনন্দ পাই পেছনে পড়ে থাকা কাজের ফাঁকে।যত দায়ভার পড়ে থাকে ধুলোয় তুলে নেই নিজের কাঁধে, না-ফেরার ভাবনা সে থেকেই জাগে; সত্যিই একদিন চলে যাব যে স্থানে যাওয়ার ইচ্ছে নেই; গেলে আর ফিরে আসবো না ; এরকম সিদ্ধান্ত নিতেও পারি না

♣ ♣
ঘরে ফেরার পথে ছায়াপাতার উল্লাসে সেদিন বাড়ি ফিরছিলাম সন্ধ্যের
আড়ালে ধানক্ষেত বনে,কেউ দেখতে পায়নি,অনুভূতি-টনুভূতি কিছুই আটকাতে পারেনি ঘরে ফেরার টানে; অনেক দুঃখকে দুঃখই ভাবি না, যদি কারো-কারো দুঃখ ছোট হয়ে যায়, মার্কেস নিঃসঙ্গতার একশো বছর লিখে ফেলছেন কবে অথচ আমার গোপন ডাইরিতে নিঃসঙ্গতার একটি মুহুর্ত্বও লিখতে পারিনি কারণ তোমার দুঃখের সরলতাখানি অতি আদরের না-আসা ভাদরের
♣ ♣
সূর্য ডুবে যাওয়ার আগে খানিকটা কৌতূহল সামনে দাঁড়ালো,ভিনদেশে বন্দি জীবনের মতো ছোটবোন দরজা বন্ধ করে রান্না ঘরে কি যেন রান্না করছে... একটু পরে জলে-তেলে-জ্বলে উঠার শব্দ কী আবহ ছড়ালো; ভাজা মাছের ঘ্রাণ নিজেকে বলছে জলদি খেয়ে নে দ্বিগুণ তৃপ্তি পাবে। কিন্তু সত্যি বলতে কি আমি ভাজা-পোড়া কিছুই খেতে পারি না,লেবুরস ঘুলিয়ে ডালভাত খেলে বুকজ্বলা বাড়ে;কিন্তু লেবু-ডাল-ভাজি এসব ছাড়া খাবারের তৃপ্তি ভাবাই যায় না।
♣ ♣
বুঝতে পারিনি কেনো পায়ে পায়ে নুড়িপাথরগুলো ধুলোতে খেলে আবার ধূলিতে মিলায়; মাটিতে পড়ে থাকা তোমার শেষ ইচ্ছাটি যদি আমাকে ফিরিয়ে দাও; তবে অন্যসব রেখে স্বেচ্ছায় নির্বাসন দীর্ঘস্থায়ী বানাবো; নিকটে থাকার সিদ্ধান্ত হয়ত আত্নঘাতী হবে বুড়ো বয়সে; নিজেকে নিজেই শুধরে নেবার পর; কিছুই মনে থাকে না; আবার কিছু ভুল ক্লান্তিহীন সুখের চেয়েও মধুর
♣ ♣
আত্নযন্ত্রণায় থাকা মনের রঙ কার প্রতি সদয় হলো; কার দেহে লবণাক্ততা চুষে নিল চৈত্রিহাওয়ায়; অথচ শৈশব কেটেছে স্বপ্নহীন থেকে মাগুরানদীর পাড়ে দৌঁড়াদৌঁড়ি দারাগুটি-কানামাছি খেলে; কৈশোর কুশিয়ারা থেকে সুরমার পাড় ঘেঁসে শ্রীমতি জলের কাছে স্মৃতিরোমন্থন; কীর্তনখোলা-বুড়িগঙ্গা থেকে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার জলে মিশে ঢেউ তুলি ব্যথায় মিশে;বেলা চলে গেলে, ফিরে পাবো কি সেই সব দিন? তাই বেশি চাওয়া ইচ্ছের চেয়েও লোভী মনে হয়,ভাল থাকা-টাকা; শরীর কি হৃদয় দু’টিই পুড়ে অহেতু ভ্রান্ত লোভে বলছি তোমাকে ওহো টাটকা,ওহো শীতপ্রিয়; গাঁথছ কি তাকে ভরা যৌবনে টেমসের হাড়ে?
 ♣ ♣
শুধু তোর জন্য গোপন রেখেছি পিপাসার বেগ,না-ছোঁয়া আবেগ; জল ছুঁয়ে নামুক ক্ষতদাগ সেদিন তোর কাছে চুম্বন চাইবে না কেউ; হাত ধরে দাঁড়াবে না আর কেনো ভয়। কারণ তুই জল ছেড়ে ডাঙায় খুঁজবে তৃষ্ণাফল; লজ্জায় না-ফোটাই ভাল আবেগের ক্ষরণ;শুধু মনে চেপে রাখিস ঘষা-মাজায় জ্বলে ওঠা দেহের চৌচির
♣ ♣
কিছুটা ভাবনায়...কোন একদিন চোখের পলকে স্বরূপে ভেসে উঠে ছিল অলস-সময় কিস্তু কি আশ্চর্য সেদিন কাউকে পোড়াতে চায়নি ভেজা... ভেজাজল-চুলের গন্ধ; ঝরাফুলের হাসি... কিংবা ঘোরস্বপ্নদিন। হাতে গোনা সময় কথাবার্তা আমার ভাল্লাগে না;কারো আবেগ অনুভূতি ভাল লাগেনি তাই এখনো অবিবাহিত, নিজের দখলেও রাখিনি মন;বন্ধু-বান্ধব নিয়ে মহানন্দে নিদ্বির্ধায় চোখে-মুখে ঘুরছে জীবন। ছায়াদের বাড়ি আজ তোমাদের হাঁটতে দেখে সারাবেলা বরফ ধোঁয়া মোছায় ডুবে আছি
♣ ♣
কেউ কেউ আমাকে শত্রুও ভাবে কনটেস্ট করে, লক্ষ্য রাখে চলাফেরা গতিবিধি পিচলা পথে কিন্তু আমার ইচ্ছাশক্তি কারো মুখোমুখি হতে দেখিনি; কারো ইচ্ছে যে আমার কাছে ছোট্ট হয়ে আসেনি তার প্রমাণ কেবল তুমি? টুকরো টুকরো মন; দেহের উচাটন ব্যর্থ চেষ্টা...এত এত বৃষ্টিঝড় ভাসতে ভাসতে দুঃখগুলান তুমি বুঝে নিতে নিতে আমি উদলামেঘের হাওয়া
♣ ♣
তুই তো জানিস?বেঁচে থাকার লোভে কিংবা অভিমানবশে কাউকে দেইনি শুভংকরের ফাঁকি; মন আপন ঘরে জেগে আছে,তাকে লক্ষ্য করে দু’চোখের আকুলতা জ্বলে ওঠে ভিনদেশে; স্বান্ত্বনাটুকু বোধের ভেতর নিজেকে সাজাতে ভুলে গেছে মনহারা হৃদয়;কেউ কেউ যে বলে; ‘বেঁচে থাকাটা দারুন ব্যাপার’ নীরব বেঁচে থাকা-টাকা-কায়া আমার পাঁজরে তাকে রাখি না সুখে
♣ ♣
তখনও পা গুনে গুনে পাড় হতে শিখিনি সাঁকো, নদীতীরে বসে জলের গভীরে নিজের প্রাণদেহে দেহপ্রাণ খুঁজি পাশ-ফিরে তাকালে বহুদূরও মনে হয় কাছাকাছি; কিছু কী বলবে? চুপিচুপি ওহো সমরূপি শুধু দূরত্ব-দাবী-দাওয়া-আর্তনাদ-বিব্রত হাসিতে পেঁচিয়ে রাখলে;কিছুই দেখলে না কাফফারাও গাঁথলে না টলে যাওয়া ঘুমে...এ-বেলায় গতি-বাতাসে কে যেন হেঁটে হেঁটে বলে গেল গাঁথা-পিনে-যত-কথা দেহের ভেতর সাড়া না পেলে মন খুলে বলতে নেই স্ফুট-অস্ফুট-কথা
♣ ♣
গ্রীন সিগন্যাল দেখে রান্তা পারাপারে চোখ লুকোচুরি খেলে দীর্ঘ লাইনে দাঁড়ালে পাতাগাছ মাথা ছুঁয়ে হাঁটে আর ডিসিপ্লিন আমাকে বিব্রতবোধ শিখতে-শিখাতে হাতঘড়ি দেখে, এসব ধরাবাঁধা নিয়মনীতি গদবাঁধা রুটিন কাজ কেনো যে ভাল লাগে না ঘুমহীন কিংবা অন্ধকাররাত ছাড়া...অন্ধকার রাতে চোখের সৌন্দর্য গুনে গুনে গ্লানি-দেহ-চুষে ভোরে রচিত যত কথাগুচ্ছ তোমারি; কতটুকু সুখে আছো পরির্পাশ্ব ডানাভাঙা পরি; ছুটির দিনে ফায়ার প্রেসে কাছে বসে কী আর বলতে পারি

Monday, March 29, 2010

কফিন, সঙ্গে লাশ

না গল্প, না উপন্যাস, না কবিতা।
প্লেনের মাল-টানা-চালানের
একটা মাত্র পৃষ্ঠা;

একশ ৩০ কেজি ওজন

হারাইছে টেলিভিশনে ভালো লাগা
বিদেশি রাস্তাঘাট আর
মানুষগুলিকে ঈর্ষা;


২.
কেজিতে দেড়শ ডলার
ওজন মেপে তোমার
দেশে ফেরত আসা

কফিন, সঙ্গে লাশ-
টাকাপয়সা কবিতাকলার দূরের জিনিস

মানুষ মরে মরে যায় দূরে দূরে
যায় টাকার দরকারে;
আমরা তো শিল্প করতেছি-

বিমূর্ত মুর্খ সব বাস্তবতা


৩.
মানুষ ঘাস খায়, ঘাস পড়ে
তাই শুনে খুশি হই
“তোমার হৃদয় আজকে ঘাস”

টাকাও মানুষের দরকার!
থাক, বলে যাবে মন্ত্রী
আর বিষয়ের মাষ্টার


৪.
তোমরা তো আসতেছো শিল্প করবে

এখানে না গল্প, না উপন্যাস, না কবিতা
শুধু প্লেনের মাল-টানা-চালানের
সম্মতির একটা পৃষ্ঠা

Thursday, March 18, 2010

কবি টি এম আহমেদ কায়সার এর গুচ্ছকবিতা

ঘুম

ভাবছি, এই ভাঙা চোয়াল আর কুজো কাধ নিয়ে
আর ঘর থেকে বাইরে বেরোব না
টেলিফোনের তার কেটে দেবো
বরফ মাড়ানো জুতোগুলো কালো বিন-ব্যাগে ভরে
রাস্তায় স্ক্র্যাপভ্যানে রেখে আসবো

আমার চিবুকে যে বাজপাখির ছায়া দেখে এক উদ্ভ্রান্ত কিশোরী
সহসা আতকে উঠেছিলো
ভাবছি, বরং সেই ছায়ার সাথে তলোয়ার হাতে
নেমে পড়বো এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে

আর আমার রক্তের অন্ধকার থেকে ঝাক ঝাক বুনো-শালিখ উড়ে যেতে দেখে
মনে পড়ে
কলাশাস্ত্রে এক অভিজ্ঞ রমনী আমাকে শিখিয়েছিলনে পাখি ধরার দুর্দান্ত কৌশল
তার কথা ভেবে ভেবে কি আমি গোপনে কিছু কাশফুল বিসর্জন দেবো এখোন?
ভাবছি আর বাইরে বেরুবো না
বাতিগুলি নিভিয়ে দেবো অলক্ষ্যে
আর দূর বরফ পাহাড় থেকে বিটোভেন যে ভূজঙ্গ তীরগুলো ছুড়ে দেন নিঃশব্দে
হৃতপিন্ডে সেই তীরগুলোর দগদগে ক্ষতচিহ্ন নিয়ে
আমি বরং ঘুমোতে যাবো; নিভৃতে ঘুমিয়ে যাবো গভীর রাত্তিরে

হিংসা
কে যেন হিংসাভরে বন্দরের আলোগুলো নিভিয়ে দিয়েছে
সমুদ্রে শিকার রেখে একা একা ফিরে যাচ্ছি, আহা! ...
তবু দেখো, ফের জাগে শিকারের মোহ;
অশ্ব-ঘঙুর শুনি কোনো এক দূরতম দ্বীপে!

রক্ত-বুদ্বুদ
আমি যেনো হোলি খেলার মাঠে
সব ভুলে
কোনোএক প্রাচীন শীতভোরে কুয়াশাভেজা নিঃসঙ্গ পাটকাঠি হাতে
কেবলি রক্ত বুদ্বুদ তুলে চলছি
কেবলি রক্ত বুদ্বুদ তুলে চলছি
আর নিস্তব্ধ নুড়ি পাথরগুলো আমার দিকে তাকিয়ে আছে অপলক
আর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে আগুন, সন্ত্রাস নাকি রক্তের ফিনকি?

ফেরা
খোপায় এটেছো দেহ; অলকে বেধেছো হাত
বয়ঙ্ক আখির শর হেনেছো এ বুকে
কামের কোদন্ড ভুরু এবার কি ছোয়াবে দুচোখে?

কেনো যে ফেরাতে চাও? আমার তো রক্তে সখি
আবাল মাটির ডাক; অনন্ত গুহাব্রত, আমূল সন্ন্যাস
ঘুমন্ত নদী ও চন্দ্র, উড্ডীণ বালিহাস হাতছানি দেয় নিরবধি
জোছনায় নয় শোনো; অন্ধকারে মুখ ঢেকে রাখি

তবু বাধো লোকালয়ে; ওখানে কি পাবে সখি ডালে ডালে পাতার প্রপাত?
ওখানে কি পাবে নদী নির্জনে বয়ে গেছে ধু ধু?
ওখানে কি পাবে ছায়া কেপে উঠে কলোচ্ছল জলে?

ডেকে যায় বুনো-অশ্ব; লিলুয়া পবন ধীরে কড়া নেড়ে যায়
পালাতে গেলেই বিধে তোমার নোঙ্গর
ঝরে রক্ত পথে পথে; ওড়ে ঘুড়ি গাঢ় বেদনায়

সভ্যতা ছিড়িবো দোহে; আদিম অরণ্যমূলে ফিরে যেতে চাই
পাথরে পাথর ঠুকে পরিশুদ্ধ হতে চাই পুনঃ
তোমার বিনম্র ওষ্ঠে পাপিষ্ঠ রক্তের ধুলো মুছে নিতে চাই

ক্রমশ পারদ-স্তর ঢেকেছে এ শরীরের দ্যুতি
...প্রেমে ও বৈরাগ্যে খুজি গৌতমের প্রত্ন-প্রতীতী

নির্মল হালদার ও আমাদের অস্বস্তি

মোস্তাক আহমাদ দীন
মানুষের জীবনের অন্যতম ট্র্যাজিক দিক হলো সে তার নগ্ন অতীতকে ভুলে যায়; আর এই ভুলে যাওয়াটুকু তার মধ্যে এমনই এক গুমান এনে দেয়— সে নিজেকে স্বয়ম্ভূ বা অযোনিজ জ্ঞান করে বসে। ব্যাপারটা ট্র্যাজিক হতো না, যদি-না এই ভুলে যাওয়াটুকু অন্যের উজ্জ্বল স্মৃতি হয়ে থাকত। আমাদের অকালবোধন-সমাজে কেউ-কেউ তো আবার জাতিস্মর-ত্রিকালদর্শী। তারা অবাক হন আর ভাবেন— এ- যে এতে ফোঁসফাস করছে, সে তো গতকালও ন্যাংটো হয়ে ঘুরল আর ও-যে একটু-আধটু নাচে-কোঁদে আর উদয়শঙ্করকে বুড়ো আঙুল দেখায়, সে-তো পরশু একটু বানরের সঙ্গেও তাল মেলাতে পারেনি; আর ও-যে চিত্রকর যে-কি না সুলতান গণেশ পাইন-এর মধ্যে প্রচিন্তনের দৈন্য খোঁজে, সে কি আলটামিরা আর দোর্দোনে উপত্যকার গুহার ভেতরের অপূর্ব রেখাচিত্রাবলি দেখেছে?

আমরা ভুলে যাই; এবং এই বিস্মৃতি তেমন সমস্যারই সৃষ্টি করত না, যদি-না ত্রিকালদর্শীদের মতো কেউ-কেউ তার কথা ও কাজ নিয়ে এসে আঘাত করত। সে- কাজ হতে নির্মল হালদারের মতো কোনও কিশোরের, যে তার বস্তু-পরিপাশ্ব থেকে আবহ তুলে এনে, নিজের অন্তরটাকে ছিঁড়ে-খুঁড়ে, সামনে যে হাড়-গাছ-লতা-আকাশ, তার সঙ্গে মিলিয়ে-মিশিয়ে এই রকম বাজনা বাজায় যে, প্রোক্ত ট্র্যাজিক চরিত্রগুলো চমকে ওঠে আর তাদের মধ্যে এক অদ্ভুত ধরনের অস্বস্তি সৃষ্টি হয়। পশুজীবনের সঙ্গে আমাদের যে-স্তরগত পার্থক্য ঠিক সেই আমরাই তৈরি করে তুলেছি- সেখানে যখন আঘাতটা লাগে তখন অস্বস্তিজনিত অনুভবটা জাগে; —ভীতি একটাই- যদি সেই স্তরটুকু খসে পড়ে অথবা কোনও বদ হাওয়া যদি উড়িয়ে নিয়ে যায়।


নির্মল হাওলাদার, জন্ম ১৯৫৪, সাকিন: এস সি সিন্হা রোড, পুরুলিয়া- এই যার বাহ্যিক পরিচয়, তাকে কেন কিশোরই বলা হলো, তা একটা বৈধ প্রশ্ন বটে; কিন্তু তার এই জন্ম তথ্যটি যদি কোনওভাবে না-আসত আমাদের কাছে, তা হলে তার কবিতানিহিত যে পরিচিয় তাতে একটি কিশোর হিসাবে তাকে অভিহিত করলে আশা করি কোনও আপত্তি উঠতো না। কারণ আমরা তো ইতিমধ্যে এই অভিজ্ঞতার মধ্য আসতে পেরেছি যে- কখনো-সখনো শিশু কিশোরদের নানাবিধ প্রশ্ন, পিতা-মাতা(গুরুজন)দের অস্বস্তিকর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যেমন: তাদের কেউ হয়তো পারক্য-বোধে আক্রান্ত- ঠিক তখনই কোনও বইয়ে শব্দটি দেখে বা কোনও ‘মাধ্যম’-এ শুনে কিশোরটি বলল : বাবা, পরকীয়া মানে কী?... প্রশ্নটি তাদের চমকে দেয়... চোরের মন কি না।


আর নির্মল এমনই এক কিশোর, চার দিদির আদর-খেয়ে-বেড়ে ওঠা যার বালকবেলা— আমরা তার সম্পর্কে শুধু এরকম দুটো-একটো কথা জানতে পারি— নির্মল হঠাৎ অন্য কোনও জগত কি আকাশ থেকে নেমে এসে বলেছে :


আমি আমার মনের মৃতদেহ নিয়ে
এই শহরের রোদ পোহাই
বন্ধুদের ডেকে বলি
আমার জীবনে রোজ রবিবার
বাবুমশাই আমি নির্মল হাওলাদার
এখনও আমার কথায় কথায় গরুর শিং ঢুকিয়ে
হো হো করে হেসে উঠেছে রাখাল বালক
_________________বাবুমশাই আমি নির্মল হাওলাদার : শ্রেষ্ঠ কবিতা
আসলে বাবুমশাইদের কী জানাতে চাইছে নির্মলের কবিতার এই ক’টি পঙক্তি— তা যেমন ভাবিত করে তেমনই তার নিরাভরন ভাষাটিও সঙ্গে-সঙ্গে স্পর্শ করে, চমৎকৃত করে। তার এই ভাষাটি সম্পর্কে দেবারতি মিত্র বলেছেন : এই দিব্য চোখ কোথায় পেল নির্মল হাওলাদার। এত সহজ বিষয়বস্তুকেও কি করে এত আশ্চর্য প্রাণ দেয়? নির্মলের কবিতা পড়তে পড়তে কখনো মনে হয় এ যেন আমিও লিখতে পারতাম, কিন্তু কই পারিনাতো। যখন ভারী জটিল গ্রন্থের চোখে ধাঁধা,মাথা টনটন, তখন নির্মলের কবিতা পড়ে বাঁচি,সত্যের ছোঁয়া পাই।

এই সত্য কি কিশোরশোভন? হয়ত; — অথবা শুধু আমরা, যারা বেশ সাজিয়ে-গুছিয়ে প্রশিক্ষিত করে নিজেদের খুব এগোনো মনে করি- তারা দেখি আর কখনো-সখনো বিস্ময় বোধ করি এই ভেবে, যখন তারও কন্ঠে সময়েরই বয়স্য ভাষা ঝলসে ওঠে-ক্ষুধায় ক্ষুধায় ক্ষুধিত হোক তবেই তো ক্ষুধিত কবির প্রদর্শনী হবে/ বহুদিন পোশাকে, প্রতিষ্ঠায় আছে, এইবার নগ্নতা মনোহরী হোক/ওর মুখ ছুঁয়ে যাক ভিখারীর ভুখ, না হলে আমি শালা টেবিল উল্ঠে দেবো/ দুমাদ্দুম লাথি মারব প্রতিষ্ঠার মুখে, বলব:/ কবি তুই দুখী হ, দুখে আছে জনসাধারণ।


না হলে নির্মল হাওলাদার সাধারণত এরকম;
নগরকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে লেখা
লেখা কি আমার?
কবিতাটি শেষ হচ্ছে এভাবে :
আমি আছি ঢেঁকির শব্দে গরুর গাড়ির শব্দে
আমি কেন যাব ঐ লেখার কাছে?
তখন এ মনে হতেই পারে যে নির্মল এই ভূবনে এসে দুর্ঘটনাক্রমে কিছু অক্ষর-বর্ণ-চিহ্ন পাঠ করে কোনোও-কোনও সময় নিজেও তার শিকার হয়ে চলেছেন। কিন্তু তা কি তার ইচ্ছের মধ্যে ছিল?... এখন কে না জানে যে আমাদের পরিপ্রেক্ষণের ক্ষমতা সেই জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে আত্মপরিচয়ের প্রশ্নে যে জাতীয়তার সাম্প্রতিক প্রসঙ্গটি উঠে আসে, তা এখন আর আমাদের কাছে হাস্যকর মনে হয় না! আমরা কী দ্রুত ভুলে যাচ্ছি তাদেরকে যারা ব্যক্তি মালিকানায় ব্যাপারটিকে এখন বুঝে-উঠতে পারে না-কেননা এই বিষয়টি আজও তাদের অভিজ্ঞতার অন্তর্গত হয়নি;—ফলে নির্মলের কবিতা যদি (এসবের কথা বাদ দিয়ে) মা-বাবার পরিচয়ই যে আমাদের একমাত্র পরিচয় নয় তা বলে, প্রকৃতি-গাছপালা-আলো-অন্ধকারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের অনিবার্যতার সেই আক্ষেপের জায়গাটুকুই খুঁজে পাব।... ফরহাদ মযহার আর-জন্মে কখনও গায়ক কখনও- নিরক্ষর হয়ে জন্মাবার আকাঙ্ক্ষা যে রাখেন তাতে, তাকে এই তথ্য-বাহুল্যের কালে অনেকভাবেই বিদ্ধ করা যাবে, হয়ত বলা যাবে আকাট রোমান্টিক অথবা ক্ষমতার ঊনত্বের প্রসঙ্গ তুলে পলায়নবাদীও বলা যাবে; কিন্তু একজন কালদর্শী মেধাবী মানুষ যখন এই আকঙ্ক্ষাটি ব্যক্ত করেন তখন তার অন্তরিত দর্শনিকতাটুকুও তো আমাদের বিচার্য বিষয় হতে পারে। তিনি তো হেগেল-মার্কস-গ্রামসি-লুকাচ-পড়ুয়া মানুষ-এক্ষেত্রে তার গ্লানিটা যে অক্ষরজড়িত, তা বোঝা গেল; কিন্তু সেই অনুযুক্ত অক্ষরের ধারন করা মর্মটা কী? তার বেদনাটাই বা কী? তা কি কথা/ স্মৃতির বেদনা-যা তার মূলের গোপন অংশটুকুকেও এমন ভাবে আক্রান্ত করে যায়... যা তিনি কক্ষনও চাননি? মনে হয়;— আর নির্মলের ক্ষেত্রে হয়েছিল কি, তার জন্মকালীন বোধটুকু পরে কে যেন বিভ্রান্ত করে তাকে জিজ্ঞাসার্ত করে তোলে—
মনে হয় শিকড়ই আমার শিরা হয়ে
আমাকে করেছে প্রবাহিত মানুষের দিকে। অথচ কে যেন বলল,
শিকড় খুঁজে নে
খুঁজতে খুঁজতে কংক্রিটের শহরে একদিন দেখি
শুকিয়ে যাচ্ছে আমার শিরা
শিকড় কি অন্য কিছু অন্য কোথাও ________________________________শিকড় : শ্রেষ্ট কবিতা


—ওই শিকড়ের প্রসঙ্গ উঠলে তো মাটি প্রসঙ্গও উঠে আসে- আবার, মাটির কথা উঠলে অনিবার্যভাবে চলে আসে মায়ের কথাও; এবং শিকড় যেহেতু শিরা হয়ে মানুষের দিকে প্রবাহিত তাই অন্য মানুষের মাটি-বিক্রয়ের মতো নিষ্ঠুরতম কাজের প্রতিবেদনটি তার কলমে উত্তমপুরুষে প্রকাশ না-হয়ে পারে না।মাটি বিক্রি করতে গেলে মনে হয়/ মাকে বিক্রি করছি... এবং মা-মাটির দাম এতেই নীচে যে— একঝুড়ি মাটির দাম আট আনা-এসবের কারণ, অস্তিত্ব, যন্ত্রণা ইত্যাদির খোঁজ করতে গিয়ে তার কবিতায় যে- প্রতিবেদনার প্রকাশ ঘটে, তার মধ্যে তার সামান্য অথচ অনিবার্য চাওয়া আছে যাতে খিদেকে খিদেই বলা যায়, আগুনকে আগুন। এই নগ্নভাষার কারবারি নির্মল- তবে, তার নগ্নতার সঙ্গে অন্যান্য কবি, বিশেষ করে সেই হিমেনেথ, যাকে নগ্ন কবিতার কারিগর হিসাবে অভিহিত করা হয়, তার সঙ্গে নির্মলের তফাৎ অনেক। সমালোচকেরা হিমেনেথের মধ্যে high spiritual Quality খুঁজে পেয়েছিলেন। নির্মলের কবিতায় তার ছিটে ফোঁটাও পাওয়া যাবে কি না— সে বিষয়ে যথেষ্ট শক পোষণ করা যায়। তার কবিতা বরং উপর্যুক্ত অনুষঙ্গের বিপরীতে প্রাত্যহিক বিষয়-আশয় এমনভাবে উঠে আসে— অবাক হয়ে ভাবতে হয় : এও তাহলে কবিতার বিষয় হতে পারে?


আসলে নির্মলের তাকানোর মধ্যে এমনই এক আপন, সহজ অথচ স্বতন্ত্র ছন্দ আছে যা অন্যেরা নানারকম ভাবে-চক্রে পড়ে ধীরে-ধীরে হারিয়ে ফেলে বা, হারিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়। তার দেখার মধ্যে শিশুর দেখনভঙ্গির একটা সাদৃশ্য আছে বলে মনে হয়-কারণ নির্মলও শিশুর মতো প্রকৃতির নানা কিছু দেখে যুগপৎ মুগ্ধ আর বিস্মিত হওয়ার তাকত রাখে। যেমন ‘পরিচয়’ কবিতায় তার একটি আনন্দ পাওয়ার কথা বলা আছে। আনন্দটা এই জন্য- একটি কাঞ্চনপাতার সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছে। এখানে আমাদেরও শিশুবেলার কথা মনে পড়ে যেতে পারে যখন কোনও কিছু দেখে আনন্দের আর সীমসংখ্যা থাকত না; তারপরও সকলকেই কি তা দেখানো যেত? এত সময়ই-বা কার আছে? নির্মলের অবস্থাও তথৈবচ- তাই কাঞ্চনপাতা দেখে তার মুগ্ধতা তৈরি হলো তা ভাগাভাগি করবার জন্যে ঘরের কাছে গিয়ে দেখা গেল, ঘরের কেউই তার কথা শুনছে না, এমন-কী ঘরও না-শুধু একটি শিশু আমার সঙ্গে ছুটে ছুটে চলে কাঞ্চনপাতা দেখতে।


নির্মলের এই ধরণের কবিতাগুলো পাঠ করতে করতে কখনো কোনও শিশুর, কখনও-বা কোনও কিশোরের একাকীত্বের কথা মনে পড়ে যায়-যে আবার বেশ অভিমানীও বটে- তুমি উপড়ে আছ উপরেই থাকো/আমি উপর দিকে মুখ করে/কথা কইব না-অথচ হিসেব করলে নির্মল এখন প্রায় পঞ্চাশ। বিবাহিত কি না জানি না, সকার না বেকার তাও জানি না; তবে অরুণ সেনের বদৌলতে এটুকু জানি : নির্মল স্বাধীন কর্মহীন আকাঙ্ক্ষাহীন আর কাউকে না কাউকে ভালোবেসে, আড্ডা দিয়ে এ জীবনটা কাটিয়ে চলে যেতে প্রস্তুত।এমন-যে নির্মল হালদার, তার গভীরভাবে না পড়ে, তার সম্পর্কে এমন ধারণা যে-কেউ করে ফেলতে পারে যে, কবিতালেখায় তার বুঝি কোন প্রকারের সচেনতা নেই। এ-বিষয়ে অরুণ সেনের জবানি : কোন কোনো কবিতায় অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তিতে বা অতিসারল্যে দুশ্চিন্তা হয়, শুধু ওই স্বভাব নির্ভরতা তার কবিতাকে ব্যাহত করছে না তো? ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ একগোছা কবিতা লিখে নির্মল সেই সংশয় দূর করে দেন। আপাতত বুঝিয়ে দেন, ওর কবিতায় ভবিষ্যৎ নিয়ে আপাতত মাথা না ঘামালেও চলবে। অরুণ সেন যে-সংশয়ের কথা উল্লেখ করেছেন সে-অভিজ্ঞতা এই দীনপাঠকেরও বহুবার হয়েছে, অন্যদেরও হয়েছে নিশ্চয়; কিন্তু নির্মলের মধ্যে কী এমন গোপন শক্তি রয়েছে যে-এতে কবিতাপাঠ-অভিজ্ঞতার পরেও কুলকিনারা খুঁজে-পাওয়াটা মুশকিল হয়ে ওঠে? কখনও মনে হয়, তারও বুঝি রয়েছে অন্যরকম গুহ্য সহাজিয়া সাধনা।


তবে এটুকু ভাবা যায় যে— তার আছে অনুভবের এক আলাহিদা ভুবন, যেখানে তার শব্দগুলো অন্যের অনুভব-অভিজ্ঞতার স্মৃতি যতটা-না মনে করিয়ে দেয়, তার চেয়ে বেশি মনে করিয়ে দেয় তার নিজের অনুভবের কথা। এই অনুভব আবার অপরকে ছুঁয়ে-ছুঁয়ে শেষপর্যন্ত স্পর্শবন্দি করে ফেলবার কিমত রাখে।... সুনীলের ‘সাদাপৃষ্টা তোমার সঙ্গে’ কবিতাগ্রন্থের ‘শিল্প-সমালোচক কবিতায়’ দু-তিন বছরের এত্তটুকুন মেয়েটি প্রত্যেকটি বস্তুকে সে তার নিজ-নিজ নাম দেয়; একদিন সে, তার মা মা বলে উঠতেই পাশের ফ্ল্যাটের লোকটি তাকে যখন বলল, কোথায় তোমার মা? সে মোনালিসার ছবির দিকে হাত তুলে জবাব দিয়েছিল ঐ যে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির অমর সৃষ্টি এই মোনালিসা যে মেয়েটির মা নয়, এমন সত্য কথাটি বলে কেউ কি তাঁকে অভিযুক্ত করবে? নির্মলের অনুভবমোড়ানো ভাবনাগুলোও যে হুবহু এরকম, তা নয়। তার ভাবনার নজির পাওয়া যাচ্ছে এভাবে- সম্পৃক্ত শব্দে একটা আঁশটে গন্ধ লেগে থাকে, সম্পৃক্ত শব্দে আসক্তিও এসে যায়, মগ্ন শব্দে এক স্নিগ্ধতা আছে, আমার মনে হয় বা, এক প্রেমিকের অসুখে প্রেমিকার শুশ্রূষা দেখতে পাই। হাসপাতালে সিস্টারের সেবা দেখি অথবা, পৃথিবী বললে গ্লোবটাকে দেখি, মানচিত্র দেখতে পাই। ধরণী বললে মা-ভূমির এক শান্ত গ্রামবাংলার নিসর্গ আমার কাছে দেখা দেয়। নির্মলের এই শব্দ-ভাবনা ব্যুৎপত্তিজনিত না অনুভবজনিত? এমন প্রশ্ন তুলে কেউ যদি তাকে আক্রমণ করেন তাতে তার নিরজর কতটা ভাবনা হবে জানি না— কেননা কখনো তার এমনও তো ভাবতে ইচ্ছে করে যে-ভুল উচ্চারণ করেও আমি যদি আমার বক্তব্য বুঝাতে পারি, তা হলে ক্ষতিই বা কি ভুল উচ্চারণে... তবে, আমাদের উচ্চারণ তো শুদ্ধ হওয়াই উচিত, তা না হলে ভাবপ্রকাশে কতটা ক্ষতি হবে জানি না, কিন্তু তাতে তো যথেষ্ট নৈরাজ্য সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা- এ বোধ আশা করি নির্মলেরও আছে। তারপরও এমন উক্তি কেন করা হয়? তা হয়ত এ জন্য যে-আমরা সহজেই ভুলে যাই ভাষাটা আদতে অনুভবেরই দ্যোতক-আমরা অনায়াসে পাণ্ডিত্য জাহির করতে গিয়ে উপলক্ষ্যটাকেই লক্ষ্য করে এ- রকম আস্ফালন শুরু করি যে তার মধ্যে একটি হাস্যকর মিথ্যে গরিমার প্রকাশ ঘটাতে থাকি। নির্মলের ‘দহন’ কবিতায় আছে আর আমার মনে হলো, তুমিও আমাকে পুড়াবে না/দগ্ধ করবে শুধু... এ স্থানে আমাদের ঐতিহ্যনিষ্ঠ জ্ঞানতো বলে, কাউকে দগ্ধ করলে বুঝে নিতে হবে তার আগে পোড়ানোর একটা অনুঘটনা ঘটেছে। নির্মলের এই কবিতাটি পাঠ করতে গিয়ে আমাদের আদিপঠন কি আদিজ্ঞানের কোনও অভিজ্ঞতা কাজে লাগল কি? নির্মল তার একটির পর একটি কবিতাবইয়ে এভাবে নানা রকম অস্বস্তির ফুল-কণ্টক ছড়িয়ে রাখেন আমাদের জন্যে। তার শ্রেষ্ঠ কবিতা জানুয়ারি ২০০০-এ বের হলো দে’জ থেকে- সেখানে সংকলিত হলো ১৩টি কবিতাবই; এরপর আদম থেকে ২০০১ এ পাতারা কাঁপে, তার পরে আরো কিছু বেরুল কি-না জানি না-তবে, শেষ বইটিও সংশয়— কাটাবার পক্ষে যথেষ্ট- এখানেও সভ্যতা-অসভ্যতা, স্বস্তি-অস্বস্তির নানা উপাদান, আছে দ্বৈধও; ওই বইটি থেকে একটি ধাঁধাপ্রকারের কবিতা তুলে নিচ্ছি, যেখান থেকে আমরা পাঠ করে বুঝে নেব, নির্মলের কবিতা যে সমালোচনা করে চলে, অস্বস্তি জাগায়-এখানে, তার কবিতাও সে রকম কোনও সুযোগ নিল কি না, নাকি শেষ দুটি পঙতিতে এসে আবারও সেই সমালোচনা :

বাসনা
(সুব্রত সোমেন ও অতনুর জন্য)
তুমি গান করছো
আর আমি গানকে ছোঁয়ার নামে
তোমাকে জড়িয়ে ধরছি।
তুমি জানো, গানকে ছোঁয়া যায় না।
তুমি কি জানো, গানকে ছোঁয়ার নামে
তোমাকে আলিঙ্গন করছি?
২.
তুমি অসভ্য বলবে না বলেই
তোমাকে জড়িয়ে ধরি
তুমি জানো, অসভ্য মানুষেরই ক্ষুধাতৃষ্ণা থাকে
তুমি জানো, সভ্যতা শেখায়
ক্ষুধাকে আড়াল করতে?
৩.
আমার বাসনা থেকে তুই, তুই আমার কে?
রক্ত তুই, আবহমান

Sunday, February 21, 2010

তনুজা ভট্টাচার্য্যের ২টি কবিতা

দ্বৈরথ

জেনেছি 'মৃত্যু এক রমনীর নাম'

তার বিরহকাতর আমি
হিরন্ময় ভুলে
দেখেছি নিবিড় রাতে
কোমল শাবক এসে ডুবে গেলে চাঁদিমার জলে ...

অপার্থিব আলো চোখে বসে আছি শতাব্দের পারে

জীবন বিস্ময় তার শতদ্রু বাঁধায় ।
তবুও গন্তব্য সেই
নির্মোহ সুন্দরের স্রোতে -

যে প্রেম নিয়তি
আমি সমর্পিত। তারও কাছে
সমূহ আকুতি....

মৃত্যু সুমহ !
আমি মুগ্ধতার ক্রীড়নক
সময়ের বাহুদ্বৈরথে


ঢাকা, ২৫ ডিসেম্বর, ২০০৯



আমার রক্তের দাগ

আমার রক্তের দাগ বহুদূরে চলে যাবে

যেখানে শিশুরা ...
গোধূলির ধুলো ওঠা পদক্ষেপে
ফিরে যাওয়া গৃহে,
আমরা যেখানে আসি মায়াময় আঁচলের গিঁটে

স্মৃতিমেঘ উড়ে উড়ে
অস্ফুট অতীতের দেহে

আমাদের ভবিষ্যত
রক্তময়
আমাদের দিন;
হোলির প্রমাদসুখে পূণ্যাচারী মানুষের ভীড়ে -

আমার রক্তের স্রোত
নির্বিকার ! কৃপাণের মুখে-
অচঞ্চল শান্ত চোখ,
আতরের ঘ্রাণে

আমার রক্তের দাগে
প্রসন্ন হাসির গৌরবে

আমার সন্তান এসে মুখ ঢাকে অনৃত আঁধারে

ঢাকা, ২৮ নভেম্বর, ২০০৯

Wednesday, February 17, 2010

কবি জাহানারা পারভীনের কবিতা : জলবৈঠক













গণক

টিয়ার ভূমিকায় অভিনয় করা সেই পাখি,
নাকি সে নিজেই টিয়া?
ফুটপাতের খাম ঠোঁটে তুলে নেয় গণকের ইশারায়।

গণকের ভূমিকায় অভিনয় করা সেই মানুষ,
নাকি সে সত্যিই গণক?
বেলাশেষে গুনে যায় দিনান্তের আয়।

নিজেকে কী মনে হয় তার? নিছক কথক এক,
শূন্য খাম যে ভরিয়ে তুলতে চায় কথায় কথায়।

গণকের মুখের দিকে চেয়ে থাকা মানুষের সারল্যে
পাখির মনে পড়ে ফেলে আসা বন, বন সংলগ্ন গ্রাম।
সবুজ উড়াল ভাবনার পাখি সম্প্রদায়।

পূর্বোক্ত মালিকের চোখের মণিতে দেখা নিজের ছবি;
প্রিয় কিশোরীর আলতা রাঙা পায়ের পদাবলি

ইচ্ছে হয় একটি খাম সে নিজেই তুলে দেয় গণকের হাতে।
নাকি ঠোঁটের কাগজের মতই শূন্য মনিব ও সহকারীর ভাগ্য!

এইসব ভাবতে ভাবতে পাখিটি দেখে
ফুটপাতে হেঁটে যাচ্ছে জনৈক পা।
হাতের খাঁচায় বন্দি তরুণ টিয়ে।
কাছাকাছি আসতেই বলে--
ভালোই তো আছো, উচ্চপদে চাকরি;
আমাকে দেখ, নিয়ে যাচ্ছে বেশ্যাবাড়ি
পড়ে থাকব এককোণে;
দূষিত কারাগারের নিরপরাধ আসামি।



কাঠ, কয়লা, ভস্মীভূত ছাই

যেসব কয়লা জ্বলতে জ্বলতে
ভুলে গেছে কাঠজন্মের ইতিহাস
তাদের বিস্মৃতি একান্নবর্তী ছাই হয়ে যায়।

পোড়া ছাইয়ে পড়ে থাকা কয়লায় দেখি বাবা, ভাই,
বন্ধুর মুখ; আগুনের হল্কায় এক একটি সুপ্ত ক্রোধ
থেকে থেকে জ্বলে ওঠে,
জ্বলে উঠতে উঠতে নিভে যায়।

এক একটি কয়লা আমাদের মিত্রতার স্মারক,
শত্রুতার প্রতীক, সহাবস্থানে থাকা বৈপরীত্য।
এক একটি কয়লা তো আমি নিজেই,
পরিবার সংঘের মাঝেও এক আলাদা একক।
বিস্তীর্ণ জলে জেগে ওঠা নির্বান্ধব চর।

ও ছাই, তুমি কি সেই ডালের ভগ্নি?
যেখানে ফাঁসি নিয়েছে প্রতারিত প্রেমিক।
সেই পাতার অনুজ, কয়েকটি হলুদ বিছে
যার অধিকাংশই কামড়ে খেয়েছে।
যার নিচে সদ্যোজাত শিশুকে
ফেলে গেছেন মা! সেই বৃক্ষের বংশধর?
পরিত্যক্ত নবজাতকের কান্না মাটিছোঁয়া
ঝুড়ি বেয়ে উঠে ওপরে ছড়িয়েছে নিষ্ফল অভিশাপ।

শ্মশান ফেরত কাঠ ও মানুষের ছাই, একাকার মিশে যায়
জলে। বৃক্ষ ও মানুষ যেমন চিরকাল পাশাপাশি থাকে।
জীবিত স্বজনের মুখ এসব ছাইয়ের বেদনার্ত মুখোশ হয়ে জ্বলে।













প্রকৃত মানুষ বাড়ে মনে, গোপনে

আদর্শিক এক নদী ডোবাপুকুরের সঙ্গে সন্ধি করতে করতে
ভুলে গেছে স্বচ্ছ জলের মানে। স্বচ্ছতা, তুমি কোন পুকুরের বউ?
গাছের ছায়ার ঘোমটায় কোন গাঁয়ে থাকো? তোমারও কি পেকেছে
একটি দুটি চুল, অকালে। অকালে মরে যাওয়া নদী, অকালে
ঝরে যাওয়া ফুলের শোকে আমাদের শোভাযাত্রা শেষ পর্যন্ত
পণ্ড করে দেয় বুনো মৌমাছি, সীমান্তের পাহাড়ি হাতির পাল।

অতঃপর গতিপথ পাল্টে হাঁটতে থাকা মরূদ্যানের দিকে;
গভীর নলকূপ, দিঘি এমনকি মজা পুকুরের গল্পও যেখানে
ভীষণ অচেনা। অচেনা ঠেকে স্ত্রীর কাছে স্বামী, পিতার চোখে
পুত্র, চেনা বন্ধুর মুখ; আর প্রেমিকার কাছে প্রেমিকের
হাত। বন্ধন ছেড়ে যাওয়া হাতেরা ফিরে না এলে পাশে
থাকে আহত প্রাতরাশ, এক পশলা বৃষ্টির মতো মুখ।

মুখের কি দোষ? মুখের নকশায় থাকে না সম্পর্কের নির্দেশনা।
বিশ্বস্ত গতিপথ। গতিপথ পাল্টানো নদীতে ভাসতে ভয় পায়
পেন্সিলে আঁকা কাগজের নাও। তাহলে তো কাগজই ভালো। তার
কাছেই অবমুক্ত করা ভালো গোপন বিস্ময়, আপসের আদালত।
তবে তো আপসই ভালো; সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের সালিশে...

ভালোও তো আপেক্ষিক। সকালের ভালো সন্ধ্যায় পাল্টে যায়।
রাতের ভালো দিনের অপরিচিত। অচেনা কিছু মুখ তবু চেনা ঠেকে
দৃষ্টির আয়নায়। কিছু কথা, মুগ্ধতা কুয়াশায় আলো হয়ে জ্বলে
ডুবন্ত জাহাজের মাস্তুলে। কিছু মুদ্রাদোষ, তিক্ততা, ঘৃণা, অপমান
আলো হয়ে পিঁপড়ের মতো পায়ে পায়ে থাকে।
মুখোশের নৈকট্য ছেড়ে চলে যাই অন্য গোলার্ধে, যেখানে
প্রকৃত
মানুষ
বাড়ে
মনে,
গোপনে...


কদমতলার প্রার্থনা

মাঠের মাঝামাঝি একটি কবর
কদমের ছায়ায় অপেক্ষায় থাকে
জীবিত স্বজন এসে তুলবে প্রার্থনার হাত

বাতাস ও বৃষ্টিরাও যোগ দেবে তাতে
অদ্ভুত স্বস্তির যৌথ মোনাজাত

সমগ্র ছায়া মাটিতে পড়ে ভেঙে ভেঙে যায়
ঘাসের ফাঁকে পড়ে থাকে রোদ ও ছায়ার ইশারা
আলো-ছায়ার ভগ্নাংশে পড়ে থাকা ধান খুঁটে খেতে
খেতে আবাসিক চড়–ই ঠুকরে দেয় রোদের আলো
কখনো কখনো ছায়াকেও। জলে ভাসা খড়কুটোকেও
যেমন ঠুকরে দেয় ক্ষুধার্ত মাছ, খাদ্যের ভ্রমে।

নিজেকে এই আলো-ছায়ার শুভার্থী ভাবি,
সেখানে খুঁজি বহুকাল আগের বিচ্ছিন্ন মুখ
দেশভাগের শিকার মানুষ যেমন নতুন মানচিত্রে
করে ফেলে আসা শেকড়ের সন্ধান

কবরের ধার ঘেঁষে
পায়ে চলা পথ
গেছে গ্রামের দিকে

ও গ্রাম তুমিও কি বৃদ্ধাশ্রমে থাকো?
কবরের অধিবাসীর মতো অপেক্ষায়
পরবাসী সন্ততির?

দূরবর্তী বিমান,
পাখির উড়াল
দূর পথিকের হেঁটে আসা দেখলেই
মনে হয়-- প্রতীক্ষার বুঝি শেষ!

বৃদ্ধাশ্রমের সহযোদ্ধারা জানেন,
বিশেষ দিনেও তার কোনো সাক্ষাৎপ্রার্থী ছিল না।
প্রবল শীতেও ছিল না, ফোন বা চিঠির উষ্ণতা।
ছিল একটি ছবি, রুপার ফ্রেমে বাঁধানো,
চোখের জলে ভেজা, পারিবারিক।

অশ্র“র দাগ বুকে নিয়ে ছবিটিও প্রতীক্ষমাণ
একটি ছায়ার।
দীর্ঘ সে ছায়াটি
আজো আসেনি,
না আশ্রম
না কদমতলায়।



এবং ছায়া...

মুখের ভাপে পরিষ্কার করা চশমার কাচে
মরা শালিক হয়ে পড়ে থাকে গোটা জীবনের ছায়া;

ঝুলে থাকা বাদুড়ের উল্টো চোখে স্থাপন করি নিজেকে
দেখি-- স্থির কম্পাসে কাঁপে দিক হারানো নাবিকের দ্বিধা।

বালতির জলে ভাসা সূর্যগ্রহণের আকাশে মাতৃভক্ত পাখির উড়াল
তার সঙ্গে যাই পশুমেলায়। সেখানে সুদর্শন পশুর চোখের মণিতে
ওঠানামা করে সম্ভাব্য ক্রেতার কোলাজ, সই করা মৃত্যু পরোয়ানা।
আর আমার চোখে ভাসে কনের আসরে
পাত্রের চোখে স্থির কনের মুখ,
গুমোট অস্বস্তিতে ঘেমে ওঠা মুখের প্রসাধন।

হন্তারকের চোখে নিজের ছায়া দেখা মানুষের আতঙ্ক
ডিঙিয়ে ফিরি বর্ষার জলমগ্ন গলিতে। সতর্ক অভ্যস্ততায়
ইটের সাঁকো পেরোতে গিয়ে পায়ের কাছাকাছি সেই
শালিকের ছায়া। ওপরের বৈদ্যুতিক খুঁটিতে
যে বসে আছে, যার মৃতদেহ গেছে নাগরিক ডাস্টবিনে।



আত্মগোপন

আলজিভের নিচে লুকিয়ে থাকা তিল,
তোমার সৌহার্দে আস্থা ছিল খুব।

যখন শস্যকাল,
বেড়ে উঠছ তিলের সংসারে;
আরো সব যমজের সঙ্গে, খোসার ভেতর শুয়ে
আয়েশে বুজেছ চোখ, সূর্যস্নানে নামা তরুণী বা
মগডালের শীর্ষ পাতাদের মতো।

শীতের রোদ পোহানো প্রসূতির গর্ভস্থ সন্তানও
যেমন নড়ে ওঠে কিছুটা, তেমনি বাতাসে
দুলে উঠলে সমগ্র ডাল তুমিও উঠেছ নড়ে।

শস্যের মাঠে কৃষ্ণাঙ্গ ভাইবোনের সাহচর্যে
বড় হতে হতে ভাবলে আর নয় মিঠেপানির দেশ।
এবার নোনাজলে স্নান।
ঢেউয়ের তোড়ে ভাসতে ভাসতে
সামন্ত বজরা, পাল তোলা জাহাজের পিছু পিছু
দেশ থেকে দেশান্তর! কালো মানুষের প্রদেশ হয়ে
সাদা বরফের নদী। এক একটি দিনকে মেপে বছরের দৈর্ঘ্যে
তুষারপাতের নিচে পড়ে থাকা বহুকাল।

এই ফাঁকে কত কী বদলে গেল জলের!
পানিকে শেখাল মানুষ জমাট বাঁধার কৌশল।
পাল তোলা নৌকায় এলো কলের ইঞ্জিন।
নদীশাসনের গল্পেও লালচে মরিচা।

ঘুম ভেঙে পরাধীন জলের ক্রন্দন, তুষার বৃষ্টিতে শ্বেত ভালুকের
নাচ, হিমালয়ের বরফ গলা দেখতে দেখতে আবারো নামলে পথে।
চলতি পথেই ঘটে শস্যের প্রথম অপরাধ। সঙ্গী তিলকে হত্যা করে
পুঁতে রাখলে বরফে। কাউকে ভাসালে জলে। ভ্রাতৃহন্তারক হাবিল।


তারপর আত্মগোপনের দীর্ঘ দীর্ঘকাল;
কখনো মিশে গেলে মানুষের দেহের তিলে।
সাপের খোলসের মতো ছেড়ে কালো আবরণ বাদামি
ছবির ক্যানভাসে, সাদা ত্বকেও কী অদ্ভুত পরিপাট্য।

কখনোবা নেমে কয়লাখনিতে,
দোয়াতের কালিতে
নেয়ে আবারো ফেরা পুরনো চেহারায়।



কুয়োতলা থেকে

সান্ত্বনায় তোমাকে পাই স্বস্তিতে বেদনায়
অচেনা ঠেকে তবু জলে ভেসে ওঠা মুখের প্রতিচ্ছবি।

বৃত্তাকার দেয়ালে গজিয়ে ওঠা শ্যাওলার অভিমান,
নিচে নামতে নামতে গাঢ় হয়ে যায়।
জলে নামলে দেখাই যায় না।
চোখের সীমানায় থাকে বৃহৎ কলসের প্রচ্ছদ।

গলায় দড়ি বেঁধে কোনো বালতি তাকে খুঁজতে নামলে
উঠে আসে একবুক থই থই জল।
জলের ছদ্মবেশে হয়তো উঠে আসে সেই।
পুরনো অভ্যাসে মাজে বাসন-কোসন, কাচে কাপড়-কাঁথা।

পার্শ্ববর্তী বুজে যাওয়া যমজ কুয়োয় তার চাপা পড়া
ইচ্ছেরা জীবিত কুয়োয় বালতি পড়লেই কেঁদে ওঠে।
মধ্যরাতের দুঃখিত কুকুরের মতো?।

বাতাস তাড়ানো শুকনো পাতারা পথ ভুলে
কুয়োয় পড়ে লাশের মতো পচে-গলে উঠলে,
কেউ কেউ ছুড়ে দেয় দু’একটি লেবুপাতা,
সুগন্ধি ফুল, আতরের ফোঁটা।

এইসব শুশ্রুষায় কি ঢাকা যাবে
বহুকাল আগের সেই দূষিত জলের ইতিহাস?
তারচে’ বরং ভেতর থেকে তুলে আনা যাক
সেই অষ্টাদশী কঙ্কাল। ব্যবহারের পর
খাকি পোশাকেরা যাকে ফেলে দিয়েছিল
নিংড়ানো চা পাতার অবহেলায়।

যুদ্ধফেরত স্বাধীনতাও যাকে উগরে দিয়েছিল পরিত্যক্ত বমির ঘৃণায়।



গতিপ্রবণ বন, বিড়াল ও লাল বলের গল্প

হামাগুড়ি দেয়া একটি শিশুর সঙ্গে
সারাবেলা খেলা করে একটি লাল বল!

তুমি কি সেই ঘরের অধিবাসী?

প্রতিসন্ধ্যায়
যার চৌকাঠে কুর্নিশ করে
এক অন্ধ বিড়াল।

লাল বলের জন্মদিন
বিড়ালটি উপহার দেয় গায়ের পশম।
শিশুটি মায়ের কাছ থেকে কোনো উপহার আদায়ে অসমর্থ হয়।
বলের বিক্রেতাও পুত্রের জন্মদিনে কিনতে ব্যর্থ পছন্দের লাটিম।
এইসব অনুতাপ, ক্ষোভ রাজহাঁসে পরিণত হলে
শিশুটি সেই রাজহাঁসের সঙ্গে খেলতে নামে।

রাজহাঁস, বিড়াল ও শিশুটিকে নিয়ে
লাল বল যায় প্রতিবেশী মাঠে,
এক সময়ের এই বধ্যভূমিতেই,
এক পূর্ণিমায়, বৃষ্টিস্নাত
গাছের আলো-ছায়ায় বিড়ালের জন্ম।

বৃক্ষ, তুমি কি ভিনদেশী সেই বনের প্রতিনিধি
ভয়াবহ দাবানল পেরিয়ে শীত পাখিদের পিছু পিছু
প্রাচীন ধর্মপ্রচারকের মতো এখানেই বিবাহ, সংসার।

তুমি কি সেই নারীর প্রতিনিধি, কাঁকনের বাহানায়
দু’হাতে জড়িয়ে রাখে সুতানলি সাপ?


ছায়াপ্রবণ একটি বন
পাতা ঝরাতে ঝরাতে
হেঁটে যায় নদীর দিকে।
ভাসমান রাজহাঁসের পিঠে হাসছে
এক শিশুযাত্রী;
পাতাকুড়ানি মায়ের সতর্ক চোখের পাহারায়।

প্রিয় বৃক্ষ, নারী ও শিশু, তোমরাও কি জেনে গেছ
মানুষের চেয়ে জলের আস্থাই অধিক নিরাপদ।
সব দুঃখই তো এক সময় জল হয়ে ঝরে।



যাত্রা

চার বেহারার কাঁধে চড়ে কে যায়?
কাকে তারা পৌঁছে দেয়?
বেদনার্ত অনিচ্ছায়, সমাধি আখড়ায়।

সেকি আমি, নাকি সেই প্রাচীন বেহালাবাদক
বহুকাল থেকে থেকে দাফনের অপেক্ষায়
রয়েছে শুয়ে ফসিলের অবয়বে।

অথবা আমার সেই বোন, বহুকাল আগে যে
এসেছিল। এ কেমন জন্ম? পৃথিবীতে এসেও
দেখা হয়ে ওঠে না রঙ, রূপ, আলো।

পিতা-- মাটি খুঁড়ে দেখা প্রথম সন্তানের মুখ।
অশ্রুসিক্ত বাতাস ও ঘাসের বেদনাকে ছুঁয়ে যায়
শোকার্ত প্রজাপতি।
যেন কে বলেছিল এসব-- কৈশোরের পাড়া বেড়ানো
দিনে, নাকি সেই ব্যাঙমা ব্যাঙমির আলাপি ঠোঁট থেকে
পানের পিক হয়ে পড়েছিল ঝরে।

শববাহকের আড়ষ্ট পা যেন মাড়িয়ে না যায়
কোনো ব্যথিত পিঁপড়ের ছানা।

কেন যেন হঠাৎ নিভে যায় পিলসুজে রাখা মাটির প্রদীপ।
আয়ুর উষ্ণতায় একটু একটু গলে যায় মোমের শরীর।



বহুদিন ভুলে আছি বিবাহিত ঘুম

এত বছর পরও খুঁজে পাওয়া যায় হারানো বাদামের খোসা!
ভেতরে মাতৃস্নেহে আগলে রাখা সম্পর্কের বীজ।

অনাথ পেন্সিল এক, কত সমুদ্র জল পেরিয়ে শেখে
সব জলমহালের গল্পেই থাকে নিষিদ্ধ গন্ধমের অনুতাপ।

মুমূর্ষু বনসাইয়ের জন্য অনুতপ্ত এক কাক নিয়ে আসে
নিজের একপাটি ঠোঁট। দমিয়ে রাখা এই অশ্বত্থের
পূর্বপুরুষের ডালেই যে কয়েক পুরুষের বাস।

তবে যে দেরি হয়ে গেল খুব!
শীতের অপেক্ষায় থাকা কুয়াশার মর্মবেদনা দেখতে
দেখতে হঠাৎ জেগে ওঠে বহুদিন ভুলে থাকা বিবাহিত ঘুম।

পলিশ করা জুতার চাকচিক্যে হেসে ওঠে
কয়লা খনিতে পাওয়া হীরের গল্প।



জল...

অবেলায় স্নান করতে আসা নারীর শাড়ি থেকে
চুইয়ে পড়া জলের সূত্রে দেখা তার সঙ্গে।

অন্ধ ভিখারির একমাত্র মুদ্রা পকেটে পুরে
হাঁটা এই তস্করের পিছু নেই।
পথে পথে দেখি ধুলো ভাঙা পায়ের পর্যটন
নখের ময়লারাও চায় মুক্ত জলের স্নান
পিঠে মুদ্রিত অযত্নে থাকা চুলের নালিশ।

ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ জোড়াতালি দিয়ে বানানো
বাড়ির শামিয়ানা। মেঘের জলভরা চোখ
কবে কোন আষাঢ় থেকে চেয়ে আছে পথ,
পরিত্রাণের।

পথে পথে চুইয়ে পড়ছে জল
বহুদিনের তৃষ্ণার্ত ধুলো তা তুলে নিচ্ছে ঠোঁটে।



অগ্নি, কাঠ, দিয়াশলাই

এত যে প্রাপ্তি; তার ফাঁকেও শূন্যতার হাট,
দেয়ালে গেঁথে থাকা বেদনার ইট।

সিমেন্টের প্রলেপের আড়ালে তার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পায়
কার্নিশে গজানো বটের চারা।
একটু পানি পেলেই যে বর্তে যায়।
চাতকের অপেক্ষা শেষে যেন জলের অভিবাদন।

এই চারার উচ্চতাকে কুর্নিশ করে পাতার নিচে
ঠাঁই নেয়া ক্ষুদ্র প্রাণীদের অনেকেই মিশে গেছে লোকালয়ে।
মিশ্র মানুষের হাটে, সেই কাঠবিক্রেতার দেখা পাই।
সব শূন্যতা মিশিয়ে কাঠে থাকে বসে।

পোড়ালে সে কাঠ বিভিন্ন রঙ হয়।
সম্পন্ন, দরিদ্র, অভিজাত,
নানা বাড়ির আগুনে নানা রঙ-- নীল, হলুদ, সাদা।
আগুনের এত এত রূপ কবে আর দেখেছে মানুষ?

বিস্ময় যখন কাটে তখন ভোর।
ভোর পেরোলেই আবারো কাঠের সওদা।
শত শত ঝাঁপি নিয়ে একজনই বিক্রেতা,
হলুদ আগুনে যার সব পুড়েছে;
ঘর, শস্য, গোলা, সন্ততি।
ছাইয়ের স্তূপ থেকে জন্মানো
এক বিস্ময় বৃক্ষেই জীবিকার ছায়া।
পঙ্গপালের মতো বেড়ে ওঠা ডালপালা
যেন ছায়া দেবে গোটা গ্রাম।

কাঠের ঘর্ষণে জ্বলে আগুন,
যেভাবে পোড়ে বন, গাছ, গ্রাম;
কথার অগ্নিতেও পুড়ে লাল
সম্পর্কের সব কাঁচা ইট।
তার মুখ থেকেও ঝরে অগ্নি,
লাল, নীল, বেগুনি।
ঘর, গ্রাম পোড়ানো সর্বনাশা আগুন;
দয়ালু বা নির্দয়।

আগুনের সেই গ্রামে গিয়েছিলাম আমিও।
বিভ্রমে, কৌতূহলে, দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে
কিনেছি এক ম্যাচবাক্স।

বাড়ির পুরনো এক পেন্সিল সে বহুরূপী আগুনে কখনো পোড়েনি।



পাখিনামা

হারানো পাখির খোঁজে যাই বনে।
বন মানে প্রজাপতি, নতুন কুঁড়িতে প্রথম রোদ,
গাছের কোটরে নরম পোকার ঘুম
খঞ্জনার বাসায় জোড়া শালিকের ছা।

পাখির বাসায় রেখে আসি বাড়ির ঠিকানা,

ছুটে যাই সেই চিঠিঘরে।
যেখানে পোস্ট করার কথা কিছু প্রতিশ্রুতি
অভিযোগ, যদি সে পাঠায় সব গান।
পুরনো সুর, নীল খামে।

ফিরে এসো পাখির পালক, জানালায়, ঘুলঘুলিতে
রেখে আসা ঠিকানায় এখন নেই আর
নতুন বাসাটাও পাখিবান্ধব, বড় ঘুলঘুলি প্রশস্ত বারান্দা।

পাখির গানের সেই সিডিটি হারিয়ে গেছে বাসা বদলের ভিড়ে।
কত যে পাখি, কত রকমের গান। ফিঙে, শালিক, টিয়ে।

কোথায় যে হারিয়েছে এসব মিঠেসুর!



প্রান্তিক শিক্ষার্থী

তুমি কি বৈশাখ মানো?
রোদ, ঝড়, জলের পদাবলি!
মানো-- সানস্ক্রিনের বর্ম পেরিয়ে
ত্বকে সুচ ফুটানো প্রখর জ্যৈষ্ঠ।

শরৎ মানলে কাশফুলও মানা চাই
স্বীকার করে নেয়া চাই তুলোট মেঘের বারতা।

মানো প্রেম? নৈকট্য?
তাহলে স্বীকার করে নিতে হয় পর্যাপ্ত বিরহ।
দুধ থেকে মৃত মাছি তুলে নিতে নিতে
তার তৃষ্ণাকেও সত্য মনে হয়।

পরাজিত জল হয়ে নয়-- যদি পারো
শিশির হয়ে স্থির বসে থাকো কচুপাতায়।
আন্দোলিত বাতাস যাকে কুর্নিশ করে ফিরে যাবে।

এই গল্পের অক্ষর লিখে লিখে স্বাক্ষরতা শিখবে
নৈশ স্কুলের প্রান্তিক শিক্ষার্থী। ঝরা পাতাদের
সঙ্গে যারা ঝরেছিল স্কুলের খাতা থেকে।


কোর্ট মার্শাল

অপরাধের চেয়ে বড় হয়ে গেলে সাজা,
আকাশ থেকে ঝরে মধ্যাহ্নের বরফ

উচ্চাভিলাষী তিল পরিণত হয় তালে।
তারপর নামে জলে, বিরল জ্যোতিষীর খোঁজে।
যার সব কথা, তসবির গোটার মতো কঠিন,
গোলাকার সত্য হয়ে যায়।
যতটা গোলাকার পৃথিবী : যতটা কঠিন জীবন।

হেলেদুলে চলা লোকাল ট্রেন বুক-পিঠের সব যাত্রী নামিয়ে
শেষ স্টেশনে যখন বিশ্রামে থামে, স্টেশনমাস্টারের
চায়ের কাপে স্বেচ্ছায় ডুবে যায় এক তৃষ্ণার্ত মাছি,
মৃত্যুর আগে সেও শোনে সেই রোদের কাহিনী;

ভোররাতে আদালতপাড়া, জেলখানা, ফাঁসির মঞ্চ ঢেকে যায়
প্রখর আলোতে, এই আলোর সঙ্গে সন্ধি করার আগেই নড়ে
ওঠে একটি রুমাল, জল্লাদের হাত। সে হাতের তালুতে থাকা
তিল এই হত্যাকাণ্ডের জন্য তাকে কখনোই ক্ষমা করেনি।

অলৌকিক সেই রোদের কাহিনী যারা শুনেছে, তাদের
সবার কবরেই জন্ম নিয়েছে কোনো না কোনো ফলের গাছ।
ক্ষুধার্ত মানুষ ও পাখিরা জানে না সেসব ফলের জন্মকথা।



অপরিশোধিত ঋণ, ছায়ার কাছে

চাদের আলোয় নিজের ছায়াকেও
মনে হয় অন্য কোনো জন,
পাশাপাশি চলছে পথ

রক্তের মতো ছায়াদেরও একই রঙ।
মানুষের মতো ছায়ারাও অসুখী, একাকী।

পুত্র পরিত্যক্তা ছায়ারা বৃদ্ধাশ্রমে থাকে,
অবিবাহিতা, স্বামী পরিত্যক্তারা নারীনিবাসে।
দুই ভবনের ছাদ একই আকাশের শিষ্য বলে
এসব ছাদে আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে উড়ন্ত পাখিদের ছায়া।

নকল মানুষের ছায়া গুনে গুনে হয়রান পাখিরা বলে,
ডানায় বেঁধে দাও কিছু তাবিজ, বেঁধে আসি বলিষ্ঠ ডালে,
তারা মানুষের অবয়বে ছায়া হয়ে যাবে।
পরস্পর গল্প করতে করতে কোনো গাছ, পাখি দেখে--
তাদের ছায়ারাও আলাপে মশগুল।
পথে পথে দেখি মৌন, আনন্দিত, শোকাহত,
ক্ষতিগ্রস্ত ছায়ারা হেঁটে যায় ব্যস্ত, শ্লথ, মন্থরগতিতে।

এভাবে আড্ডায়-গল্পে-আলাপে মানুষের ছায়ারাও
নিকটবর্তী হতে হতে সরে যায় দূরে।
এসব দূরত্ব, নৈকট্য, নিঃসঙ্গতা, কোলাহলের ফাঁকে,
নিষিদ্ধ ছায়াপল্লীতে আসা-যাওয়া বাড়ে অবিশ্বস্ত ছায়াপুরুষের।
অবসরে মায়ের কোলে শুয়ে একটি শিশুছায়া শোনে মশাদের
কাকর নিক্ষেপে অতিকায় হাতিদের নাস্তানাবুদের কাহিনী।

যেসব হিংসুক ছায়াসঙ্গী ছিল আমার,
ভেতরে সেই পুরনো কঙ্কাল,
অথচ বন্ধুর মতো হাসে।

সেই বৃদ্ধ ছায়াটাকে এখনো খুঁজি,
বৈশাখের এক দুপুরে যার কাছ থেকে কিনেছিলাম বেতের ডালা।
ভাংতি না থাকায় যে পয়সা নেয়নি। বলেছিল-- বিকেলে দিলেও
চলবে। বিকেলে যাকে আর খুঁজেই পাওয়া যায়নি।

আরো একটি ছায়াকে বহুদিন দেখি না।
প্রখর মধ্যাহ্নে যাকে আরো দীর্ঘ মনে হতো।



ঘুমে আক্রান্ত মেঘনার পাড়

মানুষের পিছু নেয়া এক সাপ
অথবা সাপের পিছু নেয়া এক মানুষ
একাকী চলছে পথ

দেখে নেয়া ভালো সাপের মণিতে আছে কি-না
পর্যাপ্ত আলোর মজুদ! তাকে না আবার পৌঁছে দিতে হয়
ফিরতি পথে সদ্য ছাড়া খোলসের কুণ্ডলিতে

মনসার কাছে নত হওয়া পিতার জেদ
পুত্রস্নেহে উড়ে যায় মেঘের প্রদেশে
কিছু প্রেম অহংয়ের জলে নেয়ে বর্ষণের জন্য বেছে নেয় বৃষ্টিগ্রাম

বৃষ্টিস্নাত আলুথালু পথে, পায়ে পায়ে
বা বুকে ভর দিয়ে কে যে পিছু নেয় কার?
সেই মাঝি, নায়ের গলুইয়ে বসে নিজেকে বাজায়,
ভরা পূর্ণিমায়--নদীর কূল নাই কিনার নাই রে...

যদি সে মুখোমুখি হয় পূর্ণ ফণার, ঘুমে আক্রান্ত মেঘনার পাড়
লাফিয়ে পড়বে না জলে, হ্যামিলনের আত্মঘাতী ইঁদুরগুলোর মতো;
দৌড়ের প্রস্তুতিতে বাড়াবে না পা, ধুলোমাখা, নতুন চরের পলিতে ভেজা,
ফাটা গোড়ালির মধ্যবয়সী পা তার বয়সের সৌন্দর্যকে আত্মসাৎ করেছে কবেই

যদি সে দংশিত হয়! কিছুই এসে যায় না, ইতোমধ্যে সে স্বীকার করেছে
মানুষের দংশন, আত্মস্থ করেছে এক জীবনের সব গরল



দৌড়

আমি সেই মেঠো ইঁদুর,
বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বেঁধে
ফিরে এসেছি অক্ষত।

পাড়া বেড়ানো বিড়াল, যে পতাকাকে ভাবে শীতবস্ত্র এক
ঘণ্টার শব্দে কর্পূর হয়ে উড়ে যায় রাতদিন বিকেলের স্বস্তি
শিশুর কোমরের কাইতনে বাঁধা ঘুঙুর,
ঝড়ো বাতাসে বেজে ওঠা মন্দিরের ঘণ্টাও অনেক শান্তিপ্রিয়
তার বিপরীতে এই আওয়াজ বড় বেশি উৎপাতমুখর।

শব্দদূষণ বিপদসীমা পেরোলে সে নিয়োজিত হয় প্রাথমিকের
দপ্তরির পদে। গুনে গুনে বাজাবে কাঁসার ঘণ্টা, প্রতি ক্লাসের
বিপরীতে, শেখানো হয় ছুটি ও বিরতির তফাৎ।

স্কুলমাঠের চোরকাঁটায় মোজা ও হাঁটু অবধি প্যান্ট গেছে ছেয়ে।
কী বিস্তৃত এই দৌড়! পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ।
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া; শহরের এমাথা থেকে ওমাথা,
ঘুরতে ঘুরতে মাথায় দৌড়ে যায়
শূন্য থেকে আজ অবধি মানবিক ভ্রমণ।

শিউলি তলায় পড়ে থাকা চুপসে যাওয়া ফুল কুড়োতে গেলে
বিড়ালটি হঠাৎ তেড়ে আসে, মাথাচাড়া দেয় পুরনো রাগ।
আমিও দে ছুট। ছুটি ভেবে শিশুরা বাড়ির পথ নেয়।

দিন মাস বছর পেরিয়ে পিছু ফিরে দেখি--
বিড়ালটির পিছু নিয়েছে এক পাগলা কুকুর।



দক্ষিণদুয়ারী বাড়ির জানালায় বসে..

যতটুকু গেলে ফিরে আসা দুষ্কর,
ততটুকু দূরত্ব খোয়া গেছে পথেই।
তবু খুঁজে ফেরা পথের দৈর্ঘ্য
পথ আগলে দাঁড়ায় পোষা কবুতরের ছায়া।
এই কি গন্তব্য, এখানেই কথা ছিল আসার?

মুদ্রার পিঠে আঁকা শাসকের ছবির স্থিরতায় আটকে থাকে
পূর্ণদৈর্ঘ্য জীবনের ফিতে। ও মুদ্রা যে টাকশালে জন্ম,
তার ভবন কি দক্ষিণমুখী? তার পাহারায় কি আছে
একটি দুটি অবৈতনিক বৃক্ষ দাস?
দক্ষিণদুয়ারী এক বাড়ির স্বপ্ন মায়ের চোখের প্লাবনে
পথ হারিয়েছে কবেই। আরো কিছু খুচরো বেদনার
আধুলির মতো একেও বেঁধে রাখেন আঁচলের খোটে।

পুরনো সিন্দুকে হাতড়ে বেড়ানো প্রত্নতাত্ত্বিকের হাত যেমন
হিমশিম খায় গুনতে মুদ্রার বয়স। আমিও তার সফেদ চুলের
পরিমাণ গুনতে গুনতে ভাবি, বরং এর চেয়ে সহজ সংখ্যালঘু
কালো চুলের শুমারি। বলিরেখা পড়া ত্বকের ভাঁজে শুশুকের
মতো সহসাই গুম হয়ে যায় শৈশবে দেখা সেই মুখের লাবণ্য।



বর্ণান্তরিত বিড়ালের অভিশাপ

পর্যাপ্ত ঘামের পর মধ্যাহ্নে সব পাখির জ্বর সেরে গেলে
মাঠে মাঠে বেজে ওঠে শস্যসঙ্গীত।

ঘর্মাক্ত পালকের একটি পাখি, খাঁচার কোণে ঝিমুতে ঝিমুতে
পুরনো অভ্যস্ততায় শোনে প্রৌঢ় দম্পতির কলহ। স্ত্রী এক
জীবনের সব ক্রোধ উগরে দেন প্রতিপক্ষের পায়ে।

সেই যে বাড়ি, পিতা মাতা সন্তান, সেই যে বিড়াল, তুলতুলে, শুভ্র,
গৃহকর্তা বাড়ি ফেরার পথে এগিয়ে আসা পায়ে পায়ে। এ কি মমতা!
নাকি পকেটে থাকা বিস্কুটের লোভ, প্রতিদিন যা বরাদ্দ তার জন্য!

সেই যে বিড়াল, এক সোফাতে বসা, এক বিছানায় ঘুম,
পায়ে পায়ে বেড়ানো সেই পোষা প্রাণী রেখে বাড়ির ছোট মেয়েটি
যেদিন পড়তে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেদিনই কপাল পুড়ল তার।
এঘরে ওঘরে সে খুঁজে ফেরা মানুষের মুখ, স্পর্শ। ঘর, বিছানা,
হেঁসেলের হাঁড়িতে। উৎপাতে উৎপাতে কমে আসে স্নেহের পারদ।
একসময় পুরোপুরি উড়ে গেলে বস্তায় ভরে তাকে ফেলে আসা হয়
দূরের মাঠে। সেবার পথ চিনে ঠিক ফিরে এলেও একদিন আর
ফেরা হয় না। ছুটিতে বাড়ি ফিরে মেয়েটি দেখে শূন্য ঘর, আঙিনা।


সেই যে বিড়াল, তার অভিশাপ কি আজো ঘিরে আছে তাদের?
বাড়িবদলে যা স্থানান্তরিত হয়েছে নতুন আবাসে। অথবা
বর্ণান্তরিত হয়ে উড়াল কোটাতে ফিরে এসেছে পাখির অবয়বে।



মাঠ বিষয়ক

হাজারো ঘাসের মৃত্যু হলে জন্ম নেয় একটি মাঠ
প্রথম শিশুর সঙ্গে যেমন জন্ম হয় মায়ের

পায়ে পায়ে ধুলো, পায়ে পায়ে বল; ও মাঠ,
প্রতিটি ম্যাচের পর তুমিও কি ক্লান্ত হও? পরাজিত
দলনেতার মতো তোমার কাঁধেও বসে থাকে বিষণ্ন সারস!
অধিক পদভারের ধুলো ওড়া ক্লান্তিতে দয়ালু আকাশ
মেলে ধরলে এক পশলা শীতল বর্ষণ, সতেজ হয়ে ওঠো
সদ্য স্নান সারা মানুষের মতো?
ধুলোমাখা বুকে মজুদ কত কত পায়ের জলছাপ!

পায়ে পায়ে ধুলো, পায়ে পায়ে বালি
ধুলোতে মিশে যায় জং ধরা পায়ের মরিচা।
এসব মরিচা জলে মিশে আরো বেশি
ভরাট করে তোলে নদীর তলদেশ।

ঈদের জামাতের পর নামাজীর হারানো জুতার একপাটি
কিংবা বালকের আধুলি এখানেই কুড়াতে আসে উৎসাহী টোকাই।



উড়াল পরিবার



দেয়ালে দেয়ালে ওড়ে প্রজাপতির ছায়া, কয়লায় আঁকা পাখি;

পেন্সিলে আঁকা বনে আছে ডালপালা কিছু, অগ্নির আয়োজন।
অগ্নি সাক্ষী রেখে বিয়ে করে প্রজাপতি ও কয়লাপাখি
তাদের উড়াল পরিবার ভালোবাসে পাখার সমতা।

এই সম্পর্কের পর প্রজাপতির সংসারে রাঁধতে বাড়তে,
খেতে পরতে পেয়ে ছায়া এমনকি পাখিও প্রজাপতি
হয়ে যায়। দেয়ালে খুঁজে পওয়া যায় না পাখার অস্তিত্ব।



পর্যাপ্ত ইট নামিয়ে গলির ট্রাক চলে গেলে
মধ্যরাত আবারো শ্বাস নেয় ঘড়ির কাঁটায়

দেয়াল হাতড়ে সেই টিকটিকিকে খুঁজি,
খসে পড়া লেজের শোকে বহুদিন নির্ঘুম;
বাড়ির সব দেয়াল যে বেদনার ভার বইতে বইতে রক্তাক্ত।

প্লেটভর্তি ঘুমের অর্ঘ্য ডুবে যায় পিপাসার জলে।
কাঁসার থালাতে যত মেদ চকচক করে তেঁতুলের ক্বাথে।
চিনেমাটির কাছে পরাজিত এই সৌন্দর্যে
এখনো রয়েছে পর্যাপ্ত মনোবল

শুনেছি ওড়ার অধিকারে খাঁচাখোলা পাখিরাও
করবে নিজস্ব বনের পত্তন। টবের শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত
বনসাই ফিরে পাবে প্রকৃত মাটি, পূর্ণদৈর্ঘ্য উচ্চতা।



ওড়ে ছাই, উড়ো হাওয়ায়


তোমার যে বোন সেবার
জলপাইপাতাকে নিয়ে সমুদ্রে গেছে
ফিরেছে আমলকী হয়ে

ঘরপোড়া গরুদের যতই বলি-- ভয় নেই সিঁদুরে মেঘে,
তাদের চোখে তবু অগ্নির প্রসঙ্গ; ভয়াবহ দাবানল।
ভেতর ও বাইরের সব আগুন থেমে গেলে সংগৃহীত ছাই নিয়ে
পথে পথে চলে বিজ্ঞাপন-- ছাই নেবেন ছাই?

নেব, আরো নেব ছাইয়ের পূর্বপুরুষ,
শেকড়, ডাল, পাতার সাশ্রয়ী প্যাকেজ;

যেসব ডালে কোনো পাখিই বসেনি, বজ্রপাতে মরেছে যে,
আর ফুল-ফলহীন গাছের গল্পগুলো বহুতল ছাদ থেকে
নিচে পড়তে পড়তে তৈরি করবে নিজস্ব ছায়া, মাটিতে পড়ার
আগেই সেগুলো কুড়িয়ে আবারো পথে নামবে কোনো বিক্রেতা;
যার হকার জীবনের সব অধ্যায় জ্বলে পুড়ে অপাঠ্য হয়ে গেছে।

জলপাই বন ও আমলকীর ডালে শুনেছি
কোনো পাখিই আর বসতে চায় না।


ইচ্ছেঘুড়ি

ইচ্ছেঘুড়ি, কতবার তুমি উড়েছ স্বেচ্ছায়?
গাংচিলের ডানার সমান্তরালে কতবার পেয়েছ মেঘমুক্ত আকাশ।

তুমি কি সেই বকের সহপাঠী, মাছের ধ্যানে একপায়ে
দাঁড়িয়ে থাকা শাপলাবিলে; সেই দুপুরের মিত্র,
দূরের কয়লাখনি থেকে যার পত্র এসেছে;
মৃত সেই রেশম পোকা, যার অভিশাপ লেগে আছে সিল্কের জামায়?

সেদ্ধ শালুকের বুক, কালচে খোসার আড়ালে হলুদ ঘুম!
খসখসে বাকলের নিচে কাঠের উজ্জ্বল, মসৃণ হাসি,

পাকা ফসলের মাঠ, অগভীর দিঘি বা নদীর জলে ছায়া ফেলে
খুব নিচু দিয়ে উড়েছ কখনো, অথবা ছায়া পড়ে না এমন উচ্চতায়,
ঈগলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, দীর্ঘ সারিতে ওড়া শীত পাখিদের
কালো রেখার পিছু পিছু গ্রাম পেরিয়ে ঢুকেছ নগরে?

দেখেছ বহুতল ছাদে ডানা মেলে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ এন্টেনা
পরিত্যক্ত জুতায় বাসা বাঁধা ইঁদুরের সংসার?
বাতাসে সিসার ঘনত্বে নিয়েছ নিঃশ্বাস!

নৌকাবাইচের বৈঠার আঘাতে কুঁকড়ে যাওয়া জলের আর্তি
এখনো কি আছে মনে, মরুভূমির নিচে চাপা পড়া
প্রত্ননগরের ঘুম। বালির স্লেটে উটের সঙ্গে লেখা সে নাম?

অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া ভবনের ওপর দিয়ে উড়তে গিয়ে
পাখিদের সঙ্গে খুইয়েছ লেজের ভগ্নাংশ,
পোড়া লেজ নিয়ে বালকের হাতে ধরা পড়ে তার হাতের ইশারায়
নাচতে নাচতে এখনো কি আটকে আছো বৈদ্যুতিক খুঁটিতে!



পরিত্যক্ত বৈঠার অবকাশ

মাথার তালুতে চুলের স্বাক্ষর,
অনুলিপি পৌঁছে দিও নখের কাছেও।

পৌঁছে দিও হাতের আঙুল বান্ধব নদীর কাছে, তুলে নিও
সব দাবি, অভিমানের শিকড়। আর যত কালো বিড়ালের গান,
ফুল তোলা রুমাল, বেলা-অবেলার যেসব গল্প
বিক্রি হয়ে গেছে খবরের কাগজের সঙ্গে, মুড়ির ঠোঙায় ফিরে
এলে তুলে দিও ফিরতি ডাকে। এসব কথা লেখা ছিল মাঠে মাঠে...
সে এক অদ্ভুত সবুজ...

সবুজ মাঠে আবিষ্কৃত গুড়ের খনি বাড়িয়ে দেয় ডায়াবেটিক আক্রান্ত
পিঁপড়ে শ্রমিকের মর্মবেদনা। এসব শুনে শুনে
হাওরের তীর্থযাত্রীরাও সমঝে চলে আকাশের মেজাজ।
সে এক অদ্ভুত নীল...

যেখানে সব সমাপ্তি ভিড়ে যায় ঝরাপাতাদের দলে,
হাওয়ায় ওড়ে ক্লান্ত পাণ্ডুলিপি, অবিক্রীত গ্রন্থের পাল,
নির্ভার চিনেবাদামের খোসা
বড় দীর্ঘ সে পথ...

যে পথের শেষ কিস্তিতে এসে পিতা হয়ে ওঠেন পরিত্যক্ত বৈঠা।
খরস্রোতা জলে একদিন যার শাসনে ছিল নিষ্পাল নৌকার গতি।

ধীরগতিতে ওড়ানো ঘুড়ির লেজের দৈর্ঘ্যে বাড়ে পুলক, বিস্ময়
সে পুলকে চোখেই পড়ে না ক্র্যাচের ভরে হাঁটা পিতার মুখের বলিরেখা
সে এক অদ্ভুত রেখা...


দুই দুগনে পাঁচ

বৃষ্টিমুখী চাতক ও মানুষের প্রার্থনা একাকার হলে
শুভেচ্ছা সফরে আসে মেঘের বহর, চোখের প্রদেশে
জলের খনি ইজারা চায় বহুজাতক চাতক

ব্যক্তিগত মজুদ ভবনে খুঁজতে গিয়ে স্বস্তির বৈঠা,
দেখি জলে ভাসা নাও এগিয়ে যায় পালের প্ররোচনায়।
আমি শুধু থাকি পড়ে, পাঠশালার ঝরে যাওয়া
শেষ ছাত্র কুয়াশায় ভাঙি পথ, হাতে আসে কাশফুলের সান্ত্বনা।

শস্য বৃষ্টির প্রত্যাশায় পাথর, বরফ, এমনকি এসিড বৃষ্টির
কথাও কানে আসে, তবে তো খরাই ভালো, দ্বৈততা নেই;
প্রকাশ্যে বলে পোড়াতেই এসেছি-- বর্ষণের বিপরীতে।

এদিকে অগ্নিরোদের নেই শীতসকালের কোমলতা,
তবে কি সে জল্লাদ, পিতৃহন্তারক ইডিপাস, অথবা
মৃত্যুকে হাতে নিয়ে লড়া রণযোদ্ধা। শুনে শুনে
তারাও তো ভালোবাসে শিশুর প্রথম কান্না।

অন্ধ বিড়ালের লেজে পা পড়লে কেঁদে ওঠে বুক
কিংবা সেই গোরখাদক মনের অজান্তেই খুঁড়ে রাখে
নিজের কবর। অথবা সেই চণ্ডাল নেশায় বুঁদ
হয়ে নির্বিকার অভ্যস্ততায় ফাটিয়ে দেয় মৃতের মস্তক।



চাষাবাদ

পর্যাপ্ত গোপনীয়তায় কিছু বীজ পৌঁছে যায় বনসাই গ্রামে।
যার জন্য কৃষক অনাবাদি রাখে সমগ্র মাঠ।

ঘূর্ণায়মান পাখারা যেভাবে অবরুদ্ধ বাতাসকে ছড়িয়ে দেয়
স্বেচ্ছাশ্রমে কেটে নিন্দার পাহাড় নিন্দুক যেভাবে প্রতিটি টুকরো
ছড়িয়ে আসে এখানে সেখানে, সেভাবে এই খবরও প্রচার হয়ে যায়।

প্রচারিত হয়-- ভোরের মাঠ থেকে সংগৃহীত শিশির, যে গ্লাসে গ্লাসে
করে জলের অভিনয়, সে জলে এই বীজ, একরাত ডুবালে
অংকুরিত হবে। এই জল খাবে এক বৃদ্ধ,
সন্তানের আশায় যে একের পর এক বিবাহে জড়িয়েছে।

খরাক্রান্ত জমিতে পোতা হলে সেই বীজ। রেললাইন ধরে ছুটে
আসে দ্বিমুখী নিঃসন্তান অজগর। শালুকগর্ভা এক শাপলাবিল
সন্ন্যাসী বকেরা যেখানে স্বেচ্ছায় ধরা দেয়,
সে তার সব জল অনুদান দেয় এই চাষে।

বৃক্ষহীন গ্রামের পাখি ও মানুষেরা ভাবে তাদের রোদে পোড়া
পিঠ ও কষ্টে পোড়া মন পাবে প্রকৃত বৃক্ষের ছায়া।
অবশেষে আবারো সব গাছ বনসাই হয়ে গেলে আশাহত
মাটি ও মানুষেরা ধোঁয়ার কুণ্ডলী হয়ে গৃহত্যাগী হয়।
বহুদিন পর ফেরে নতুন কৃষিকৌশলে।

মানুষের মতো প্রকৃত বৃক্ষেরও চাই বেড়ে ওঠার স্বাধীনতা,
বায়ু, জল, আলোর পরিচর্যা।



প্রতিটি মানুষই এক একজন ব্যর্থ সহিস

রোলটানা পাটিগণিতের খাতা,
তোমার কাছেও আছে কিছু ঋণ

কবে কোন ছুটির দুপুরে কাঁঠাল মুচিকে দেখিয়ে নখের ক্ষমতা,
কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি কুড়ানো লাল দিনে, কোমল পাপড়িতে যুদ্ধ
বাধাতে বাধাতে তোমার বুকে কাটা একটি দুটি আঁচড়।

অন্তমিলে সাজানো কিছু শব্দের খসড়া, প্রাথমিক তুষ,
আবেগের দিয়াশলাই নিজ হাতে ছোড়া পেন্সিলে
আঁকা খড়ের গাদায়, স্বরচিত আগুনে পোহানো
শীতের উত্তাপ। চোখের সঙ্গে জাগিয়ে রাখা তোমাকেও।

তোমার মলাটে জমা ধুলোর প্রলেপ মুছে দিতে দিতে ভাবি
কিছু বিষ কীভাবে যে মিশে যায় পাস্তুরিত দুধে!

তবে কি প্রতিটি মানুষই এক একজন ব্যর্থ সহিস!



হালদার মাতৃমাছ

জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় মাছের খামার,
প্রসবিত ডিমের জন্য কাঁদে মাতৃহৃদয়,
খামারির বিমর্ষ চোখের নুনে হাওয়া দেয় গৃহমন্দা।
মাছ ও মানুষের অশ্রু শেখে একই নামতা।


হালদায় ডিম ছাড়তে আসা রুই, কাতলার বেদনায় ছেয়ে যায়
উর্বরা জলের ভাণ্ডার। ডিম সংগ্রহে আসা জেলেরা শোনে
বাতাসে ছড়িয়ে থাকা আসন্ন প্রসবা মাছের শোকগীত।
জলের নিচ থেকে ওঠা বুদবুদে মাছেরা প্রকাশ করে ভবিষ্যৎ
প্রজন্মের সঙ্গে দেখা না হওয়ার শোক। সংগৃহীত ডিম নিয়ে
যারা ফিরে যাবে তাদের আনন্দের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।

আহা মাতৃ মাছ, প্রসবিত ডিম থেকে জন্মাবে যে শিশু
তাকে কে শোনাবে ঘুমপাড়ানিয়া গান? শেখাবে জলের সংগ্রাম।
কখনো হবে না দেখা মায়ের মুখ, জানবে না কুল-পরিচয়!



ভূমিকম্প... রিখটার স্কেল ৭.৮

এখানে সেখানে, খসে গেছে পলেস্তারা;
বেরিয়ে পড়েছে ইটের লাল মুখ,
হঠাৎ দুর্ঘটনায় চামড়ার পাহারা পেরিয়ে
যেমন প্রকাশিত হয় রক্তের রূপ।

প্রায়ান্ধকার সেই বাড়ি, দেড়শ’, দুইশ’ কিংবা
এই শহরেরই সমান আয়ু নিয়ে এখনো চলছে পথ,
শতবর্ষী বৃদ্ধার গতিতে। অন্ধকার সিঁড়িতে পথ ভাঙা দায়,
দেখা যায় না শরীর, অমাবস্যায় যেমন বৃক্ষও
দেখে না ডাল-পাতার রঙ।

বহু শরিকের বাড়ির কিছুটা অংশ সংস্কার করা,
মোটা দেয়ালে চুনকামের হাসি। শেষ কবে রেখেছি পা,
সেই স্যাঁতসেঁতে সিঁড়িতে? এক যুগ? সেখানে তখন
থাকেন মা, বাবা, ভাই ও ছায়ানটে গান শেখা কন্যা।
স্কুলপড়–য়া সেই মেয়েটি এখন কত বড়?
মাকে নিয়ে এখনো কি ছায়ানটে যায়?

ভূতাত্ত্বিক প্লেটের প্ররোচনায়, ক্ষেপে ওঠে মাটি,
যদি ভয়ানক ক্রোধে নড়ে ওঠে এ শহর,
বুবলি, আমার ছাত্রী-- বাঁচবে তো?

ঘুমন্ত সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে থাকি, অসহায়।



তৃষ্ণা, বালি, প্রতিকৃতি

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে
আকাশ থেকে যে স্নেহ
ঝরে পড়ে, তা জলমাত্র নয়

কত পুরনো নদী
জল জল করতে করতে
বালি হয়ে গেল।

জলের হাহাকারে এসব নদীর ক্রন্দন
শিশির হয়ে মিশে যায় বৃষ্টিস্নাত পাতায়।
স্নেহের বাষ্প হয়ে ওড়ে হাওয়ায়।

বালির পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে
মৃতনদীর জানাজায় শরিক হওয়া মাছ,
গাছ, পাখিদের মনে হয় সেই পাথরের কথা।
যার আঘাতে আঘাতে জন্ম বারোটি ঝর্নার।
তাদের আশা-- এভাবে বালিতেও যদি সৃষ্টি হতো ফোয়ারা।

মৃতনদীর প্রতিবেশী পাখি, গাছ, কীটপতঙ্গ, এমনকি মানুষেরাও
তাদের বাকল, ডানা, পালক হাতে আঁকত সেই বালুচরের ম্যাপ।
অশ্রুতে তৃষ্ণা মেটানো পাখির ডানায় লেখা যেত ফোয়ারার ঠিকানা।
একটি একটি করে নুড়ি পাথর ফেলে কলসির তলানির জলে
তৃষ্ণা মেটানো কাকের বংশধররাও হিজরত করত সেখানে।



পাখা পুড়ে যাওয়ার পর

ছুলেই জমে যায় হাত; জমাট বরফের চাই,
তুমি বরং জল হয়ে যাও, স্বাগত জানাও
মাছ ও মানুষের তৃষ্ণাকে।

যেসব প্রজাপতি এখনো ফেরেনি ফুলের মিছিলে তাদের
খোঁজে ভিনগাঁয়ে পৌঁছে দেখি অগণিত ছাইয়ের স্তূপ।
পাশেই উদ্ধারকৃত জাহাজের খোলে পাওয়া
মাছের শব থেকে ছড়ানো আঁশ।

বরফকলের জল যেভাবে গান গাইতে গাইতে জমে যায়,
যেভাবে থেমে যায় জিয়ল মাছ ডিপ ফ্রিজের খোলে,
শীতল সমুদ্রে যেভাবে ডুবে যায় জাহাজডোবা যাত্রী,
মৃতবাড়ি যেভাবে ভরে যায় প্রিয়-অপ্রিয় শুভার্থীর পদধুলায়।
সেভাবেই আহত ভাইয়ের শুশ্রুষা করে শালিকের বোন।

শবের স্বজনেরা শুধু পেছনেই ফিরে যান,
স্মৃতি খুঁড়ে তুলে আনেন সম্পর্কের বাসি আনাজ,
যদিও সেখানে বন্ধন নেই
কোনো প্রজাপতি বা তাদের পাখার।

প্রজাপতি জীবদ্দশাতেই অনুগত থাকে পাখার;
স্বজনেরা মৃত্যুর পরই হয় নিঃশর্ত ও মানবিক।



স্বীকারোক্তি

কিছু পিঁপড়ে প্রায়ই বাঁচিয়ে দেই।

উপদ্রব বেড়ে গেলে, সন্তানের বিছানা, বালিশে তোশকে,
খাটের আনাচে কানাচে আস্তানা গাড়লে, চিরুনি অভিযানে
নিহত পিঁপড়ে, কিংবা ডিপ ফ্রিজের শিং মাছগুলো,
তাদের দাপাদাপির দৃশ্য, জমে যাওয়ার আগে
প্রাণান্তকর বাঁচার চেষ্টা; হানা দেয় মনে॥

অথবা সেই খাসি দুটো, জবাইয়ের মুহূর্তে;
শেষ চিৎকারে জানিয়ে গেছে তীব্র ঘৃণা, রক্তে রাঙিয়ে
হন্তারকের পাঞ্জাবি; তারাও হাজির মাঝরাতে।

পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নিহত পিঁপড়েরাও
স্লোগানে স্লোগানে ভাঙায় ঘুম।
শিং মাছগুলো বসে থাকে প্লেটে, বলে--
স্বীকার কর, ঠাণ্ডা মাথায় হওয়া এসব খুনের ঘটনা।

নিজেকে সেই হাঁসের চেয়ে উত্তম মনে হয় না,
সেই পৃথুলা হাঁস, থকথকে কাদার উঠোনে হাঁটতে গিয়ে,
পায়ের নিচে নিহত পিঁপড়ের জন্য নিজেকে যার খুনি মনে হয়।



ইস্তফা

নিশ্চই আমি পদত্যাগী;
নইলে এই কুয়াশার বাগানে জোনাকি ধরতে আসা!

কথা ছিল পৃথিবীর সবচে’ শীতার্ত দিনে
আকাশের গর্ভে মেঘের জন্ম হলে,
পাতাদের চোখের অশ্রু মুছে দিতে
বহুকালের গুহাবাসী আমি বের হবো প্রকাশ্যে।

সূর্যগ্রহণের মতো সেই মুহূর্তও মহাজাগতিক ঘটনা
হিসেবে আখ্যায়িত হবে আঞ্চলিক অভিধানে।

স্বেচ্ছানির্বাসন না পেরোতেই এই আস্থা!
পাখিরাও এখন আর বন্ধু নয়,
প্রিয় সন্তানের মতো পোষা কুকুরও সরে যায় দূরে।
পিঠের পালক তাই খুলেছি স্বেচ্ছায়।
অবিশ্বস্ত আকাশে ওড়ার কোনো মানে হয়!

তোমরা কি দেখনি,
শত্রুর বুলেটে কিভাবে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে পা?
শোননি, উত্তাল সমুদ্রে কিভাবে লড়েছি হাঙরের সঙ্গে?
একটি ডলফিন শুধু পথ দেখাতে পাশে ছিল সারাটা পথ।

সব বিসর্জনের পর দেখি--
ঝড়ে বিধ্বস্ত একটি কলাগাছ এখনো বাঁচতে ভোলেনি;
আছাড়ে, হাপুরে একটি শিশু নিচ্ছে গতির প্রথম পাঠ।



সহমরণ-ক

এক একটি পাতা খুলে নিয়ে তোমাকে উলঙ্গ করতে চায় যারা,
বন্ধু মানো তাদের!
স্বজন হয়েও তারা একটু একটু করে খুলে নিচ্ছে বাকল বর্ম।
নির্বান্ধব ত্বক থেকে ঝরে পড়া অভিমান, বিষাদ, তোমার স্বপ্ন,
উচ্ছ্বাস, ভেঙে পড়ায় তাদের এসে যায় না কিছুই।

তবু নিজের হাত পা, শরীর, সর্বাঙ্গ পুড়িয়ে তাদের উনুনের
হাঁড়ি জ্বালিয়ে রাখ প্রতিদিন।
সেই উনুনে আমিও পুড়েছি বহুবার,
উত্তরপুরুষেরা চুলার ছাই থেকে একদিন খুঁজে পাবে
হাতের বালা, গলার মাদুলি, প্রিয় নাকফুল।


সহমরণ-খ

ঘাসের সমাধি খুঁড়ে পাওয়া হাজারো ঘাসের কঙ্কালে জমে ওঠা কুয়াশা
সবুজ হয়ে উঠলে অলৌকিক এক নদীর কথা মনে হয়।
জলে জলে খড়কুটোর হাসি, রূপসী মাছের সাঁতার,
সোনালি বাষ্প জলের আবরণ ভেঙে হয়ে ওঠে হাতের কাঁকন,
গলার মাদুলী, ছোট্ট নাকফুল। ঘাসের কঙ্কালের আশেপাশেও
আবিষ্কৃত হয় এ রকম অলংকার।

প্রত্নখননে পাওয়া যায় আরো কিছু তথ্যের হাঁড়িকুড়ি।
যেখানে পাওয়া যায় নারীদের চুলের দলা, হাতখোঁপায় বাঁধা সৌখিন কাঁটা,

এই মাঠেও একদিন জনসমাগম হতো,
সমবেত জনতার উৎসাহী চোখের সামনে
এখানে জ্বলে উঠত সহমরণের চিতা




বর্ষসেরা মেঘের আসর

কাশবনে হারিয়ে যাওয়া বিড়ালের বাদামি চোখ
ডুবে যায় খড়কুটো হয়ে দীর্ঘ জলোচ্ছ্বাসে;
ডুবন্ত বালক তা আঁকড়ে ধরে মার্বেল ভেবে
হাতের মুঠোতে খেলা করে
চোখ ও মার্বেল, মার্বেল ও চোখ।

কাকে যে স্তুতি করো! কাকে যে ঘৃণা!
কার চোখে চাষ করো নিন্দার ধান,
চাতালের নারীরা সেই ধানে সিঁথি কাটে অভ্যস্ত পায়ে।
ফাটা গোড়ালির ফাঁকে বিঁধে থাকা কিছু ধান, ধুলো
সেসব বিবর্ণ পায়ের পরাস্থ প্রজা।

আহা! সম্পর্কের সব ভাঁজ খুলে দেখি
স্বার্থের একমুখী তিল ডুবে যায় গালের টোলে।
প্রত্ন পাথরের ঘুম ভাঙিয়ে একটি শিশু প্রজাপতি
পৃথিবীর সব পাখির কাছে নমস্য হয়,
ডানার ওমে জমা হয় সেই পাথরের শতাব্দী দীর্ঘ ঘুম।
যার ছিটেফোঁটা এসে জমেছে চোখের পাতায়, তাই
আমিও খুইয়ে আসি শাপলার বিলে বিশ্বাসের একমাত্র কয়েন।
চুলের সমাধিতে রেখে আসি কেশ তেলের কৌটা

তোমাদের বর্ষসেরা মেঘেরা বৃষ্টির মোড়কে ফিরে আসে উঠোনে
বলে-- আমরা আকাশের পরিত্যক্ত সন্তান,
ভালোবাসি তৈলাক্ত উঠোনের ক্যানভাস,
ধুলো ওড়া দিনে আকাশের প্রত্যাখ্যানে
যেখানে ঠোঁটের তুলিতে এঁকে ফেলা যায়
যেকোনো জন্মের ছাইরঙা পোর্ট্রেট।

বর্ষসেরা মেঘ, সব কৃষকের জমিই প্রত্যাশা করে জলের।
অথচ বেছে বেছে তুমি বর্ষিত হও সম্পন্ন উঠোনে।



জলমহালের অশ্রুসিক্ত গাঁথা

সহজ মুখের নির্লিপ্ত পাঠ ভুলিয়ে দেয়, ঈর্ষার কাঁটা
থাকে সবার বুকেই। আবিষ্কৃত শিলালিপি জানায়--
লিপিকারদের প্রেয়সীরাও ভালোবাসতেন বর্ণমালার ঘ্রাণ
বসন্তের প্রতি যেমন আনুগত্য কোকিলের

তবু বলি একক আনুগত্য ছেড়ে, পথের ধুলো যত
মাখবে আঙুলে ভ্রমণের দৈর্ঘ্য ছেঁটে ফেলবে স্বজনের তালিকা।
তবু সেই শ্যাওলা প্রজন্ম যারা বেড়ে উঠছে শুনে শুনে শতবর্ষী
কাছিমের গান, নির্লিপ্ত থাকবে চেয়ে। পাড়ের কড়ই গাছেরাও
বিস্ময়ে দেখবে জলে পড়া ছায়া। সে ছায়ার নিচে থাকা
মাতৃ মাছেরা, জলের নামতা পড়তে পড়তে শিশুদের
শোনাবে ঘুম পাড়ানিয়া গান। মেলে ধরবে জলজ রূপকথা।

কেউবা ফিরে যাবেন পূর্বপুরুষের ফেলে যাওয়া
গল্পের ঝাঁপিতে। গল্প নয় সত্যি। মুক্তিসেনার লাশ পানিতে
পচে গলে কীভাবে ছড়িয়েছিল দুর্গন্ধ! হাত-পা বাঁধা সেইসব
মৃতদেহ দেখে অঝোরে কেঁদেছিল মৎস্য নারীরা,
এমনকি কঠিনপ্রাণ কইয়েরাও। তাদের অশ্রু দিঘির জলে মিশে
সেবার বর্ষার অনেক আগেই ডিঙিয়েছিল পাড়ের সীমানা।



নগর...ডোবা...জল

কাছেপিঠে যত নদী-- দূষিত জলের কান্না;
কাছেপিঠে যত গাছ-- ঝরাপাতার উৎসব
শেষে ইটভাটায় মরেছে ডুবে।

এই জনপদে যেদিন প্রথম রেখেছি পা
সেদিনই বরাদ্দ হয়ে গেছে দূষিত সিসা।

মৃত্যুর আগে প্রতিবেশী ডোবাপুকুরটি ফুপিয়ে কেঁদেছে প্রতি রাতে।
সে কান্নাকে গোপনে পাহারা দিয়েছে অধীনস্থ বুকের কচুরি ফুল।
যেভাবে কাকতাড়–য়া থাকে ফসলের পাহারায়,
ক্লান্ত মা যেভাবে পাহারা দেন সন্তানের অসুখ...

ঘোর বর্ষণেও যে বৃদ্ধ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম গো
সদস্যের জন্য কচুরিপানা কাটতে আসত, সেও শোনে
নির্মাণাধীন ফ্ল্যাটের নিচ থেকে ভেসে আসা জলের হাহাকার।
যে মাছ বিক্রেতা পাশের ডোবা থেকে
ধুয়ে নিত বেলাশেষের শূন্য হাঁড়ি, মলিন হাত-পা,
সেও বিস্ময়ে দেখে নতুন গড়ে ওঠা বাড়ি।

বৃষ্টি নামলেই যে বালকেরা পাশের জমিটুকুতে মেতে উঠত ফুটবলে,
সদ্য তৈরি টিনশেডের কোনো কিশোর হয়তো তাদেরই সহপাঠী।

বহু বছর পর সন্তানকে যদি এখানে নিয়ে এসে বলি--
এই যে বহুতল ফ্ল্যাট, একদার সে পুকুর,
তার পাড়ে গজিয়ে ওঠা কচুশাক থেকে
সে পেয়েছে মাতৃগর্ভের ক্যালসিয়াম, আয়রন।
এখানেই সে শুনেছে ত্রিশুলের ফলায় গেঁথে থাকা পাখির ক্রন্দন।
কাদাজলে ঠোঁট ডুবিয়ে খাবারের সন্ধানে
ডুবসাঁতারে মেতে ওঠা হাঁসের ডাকাডাকি,

তার বিস্মিত চোখে হয়তো ভেসে উঠবে
বেগুনি কচুরিফুল, টলটল জলের সরোবরে,
ভেসে ওঠা তিতপুঁটির ঝাঁক।



হন্তারক

মাঘের জঙ্গলে আগেভাগে গিয়ে
যারা বাঘের কবলে পড়েছে
আমি তাদেরই দলে।
গোলপাতা, মধু বা কাঠের প্রয়োজনে,
আযৌবন এসেছি এখানে।
বাঘের পদচিহ্ন খুঁজে খুঁজে ভেঙেছি পথ।

আমার কন্যাদের বলো-- তাদের ব্যর্থ পিতা, গোলপাতার ভাই,
জোনাকিপোকার সহপাঠী, কাঠের বিকল্প কাঠ,
যার পিঠে পেরেক ঠুকেছে মহাজনের ঋণ।
কুয়াশায় ভেসে বেড়ায় যেসব জোনাকি
আমার ভিটেতে তারা তালগাছ হয়ে জন্ম নেবে।

নদী সাঁতরে যে বুড়ো বাঘটি গ্রামে ঢুকেছে,
ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, সেই হন্তারক আমার!
দেড় যুগ বয়সী জীবনের সেই ছিল শেষ দিন।
স্ত্রীর চোখের অশ্রু মাটিতে পড়েই শুকিয়ে গেল।
বাঘের পেট চিরে দেখ, ভেতরে দিব্যি বেঁচে
সেই চিরচেনা আমি।

পুত্রের হত্যাকারীর পিঠের চামড়ায় বসে বৈঠক চলছে,
অথচ পুনর্বার নির্বাচিত হচ্ছে পিতার খুনি...

কিভাবে পেয়েছ ক্ষমা নিজের কাছে?



অতিথি

চেনা যায়? জলবাহকের ঘটি থেকে চুইয়ে পড়া জল
তৃষ্ণার্ত ধুলোয় গেছে মিশে
মায়ের চোখ থেকে ঝরা অশ্রু, সন্তানের
আহত বাক্য যাকে ডেকে এনেছে গালে
মাছের শেষ নিঃশ্বাসের সাক্ষী সেই দা
বিভাজিত করেছে জিয়ল মাছের শরীর

সবজির ভেতর বেড়াতে আসা এক পোকা,
নিঃসংকোচে কেটেছে অন্তর্গত সিঁদ
অনুতপ্ত মায়ের বুকে চেপে বসা এক ভারী পাথর
বারবার হত্যা করেছে সন্তানের ভ্রুণ।
আলমিরা থেকে খোয়া যাওয়া গ্রন্থ,
প্রাপকের কাছে এখনো হয়নি ফেরা।
হাসপাতালের চুরি হওয়া শিশু,
বেড়ে উঠছে ভুল মায়ের সাহচর্যে

এরা সবাই নিমন্ত্রিত আজ, ঘাসের কুলখানিতে।

মায়ের অনুতাপের অশ্রু যখন পোরোলে চিবুকের সীমানা,
সাক্ষী থাকে ফুলতোলা বালিশে ক্রন্দনের চিহ্ন আঁকা জল,
ইটের নিচে চাপা পড়া হলুদ ঘাসের শেকড়ে বাসা বাঁধা
পোকার সংসারেও বসে থাকেন এক উদভ্রান্ত মা,
সবজিবাসী সেই পোকার মতো।
কৃষকেরা যাকে তাজা কীটনাশকসহ তুলে নিয়ে যায় হাটে।

ক্রোধের বঁটিতে কেটে, বিশুদ্ধ অশ্রুতে ধুয়ে, অনুতাপের আগুনে
কী রাঁধা হচ্ছে? কীটনাশকের ব্যঞ্জন? নকি পোকার ঝালফ্রাই!

অনুতাপের কিছু রেখা যতই মুছে দেয়া যাক
ক্রমেই তা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে



স্বপ্ন

শুধু স্বপ্ন দেখার অপরাধে ফাঁসি হয়ে গেল!

তবুও সান্ত্বনা-- ঘোর অমাবস্যায়
বয়ামে বয়ামে জ্যোৎস্না পোষা।
অন্ধকার জীবনে এক একটি বয়াম লণ্ঠনের মতো জ্বলে।
স্বপ্ন ছিল-- এই জ্যোৎস্নায় কেটে যাবে
মরু অঞ্চলের মতো দীর্ঘ এক একটি রাত।
শ্বেত ভালুকেরা তুষার ঝড়েও যেভাবে হেঁটে যায়,
সেভাবে পাড়ি দেয়া এক একটি বিষণ্ন দিন।

এ তল্লাটে স্বপ্ন দেখলেও ফাঁসিতে ঝুলতে হয়।
আশেপাশে খুঁজে পাবে আরো কতশত কঙ্কাল
স্বপ্ন দেখেনি বলে যাদের হত্যা করা হয়েছে।

তবু হায় মৃত্যুকে কুর্নিশ করতে নেই।