Wednesday, February 17, 2010
কবি জাহানারা পারভীনের কবিতা : জলবৈঠক
গণক
টিয়ার ভূমিকায় অভিনয় করা সেই পাখি,
নাকি সে নিজেই টিয়া?
ফুটপাতের খাম ঠোঁটে তুলে নেয় গণকের ইশারায়।
গণকের ভূমিকায় অভিনয় করা সেই মানুষ,
নাকি সে সত্যিই গণক?
বেলাশেষে গুনে যায় দিনান্তের আয়।
নিজেকে কী মনে হয় তার? নিছক কথক এক,
শূন্য খাম যে ভরিয়ে তুলতে চায় কথায় কথায়।
গণকের মুখের দিকে চেয়ে থাকা মানুষের সারল্যে
পাখির মনে পড়ে ফেলে আসা বন, বন সংলগ্ন গ্রাম।
সবুজ উড়াল ভাবনার পাখি সম্প্রদায়।
পূর্বোক্ত মালিকের চোখের মণিতে দেখা নিজের ছবি;
প্রিয় কিশোরীর আলতা রাঙা পায়ের পদাবলি
ইচ্ছে হয় একটি খাম সে নিজেই তুলে দেয় গণকের হাতে।
নাকি ঠোঁটের কাগজের মতই শূন্য মনিব ও সহকারীর ভাগ্য!
এইসব ভাবতে ভাবতে পাখিটি দেখে
ফুটপাতে হেঁটে যাচ্ছে জনৈক পা।
হাতের খাঁচায় বন্দি তরুণ টিয়ে।
কাছাকাছি আসতেই বলে--
ভালোই তো আছো, উচ্চপদে চাকরি;
আমাকে দেখ, নিয়ে যাচ্ছে বেশ্যাবাড়ি
পড়ে থাকব এককোণে;
দূষিত কারাগারের নিরপরাধ আসামি।
কাঠ, কয়লা, ভস্মীভূত ছাই
যেসব কয়লা জ্বলতে জ্বলতে
ভুলে গেছে কাঠজন্মের ইতিহাস
তাদের বিস্মৃতি একান্নবর্তী ছাই হয়ে যায়।
পোড়া ছাইয়ে পড়ে থাকা কয়লায় দেখি বাবা, ভাই,
বন্ধুর মুখ; আগুনের হল্কায় এক একটি সুপ্ত ক্রোধ
থেকে থেকে জ্বলে ওঠে,
জ্বলে উঠতে উঠতে নিভে যায়।
এক একটি কয়লা আমাদের মিত্রতার স্মারক,
শত্রুতার প্রতীক, সহাবস্থানে থাকা বৈপরীত্য।
এক একটি কয়লা তো আমি নিজেই,
পরিবার সংঘের মাঝেও এক আলাদা একক।
বিস্তীর্ণ জলে জেগে ওঠা নির্বান্ধব চর।
ও ছাই, তুমি কি সেই ডালের ভগ্নি?
যেখানে ফাঁসি নিয়েছে প্রতারিত প্রেমিক।
সেই পাতার অনুজ, কয়েকটি হলুদ বিছে
যার অধিকাংশই কামড়ে খেয়েছে।
যার নিচে সদ্যোজাত শিশুকে
ফেলে গেছেন মা! সেই বৃক্ষের বংশধর?
পরিত্যক্ত নবজাতকের কান্না মাটিছোঁয়া
ঝুড়ি বেয়ে উঠে ওপরে ছড়িয়েছে নিষ্ফল অভিশাপ।
শ্মশান ফেরত কাঠ ও মানুষের ছাই, একাকার মিশে যায়
জলে। বৃক্ষ ও মানুষ যেমন চিরকাল পাশাপাশি থাকে।
জীবিত স্বজনের মুখ এসব ছাইয়ের বেদনার্ত মুখোশ হয়ে জ্বলে।
প্রকৃত মানুষ বাড়ে মনে, গোপনে
আদর্শিক এক নদী ডোবাপুকুরের সঙ্গে সন্ধি করতে করতে
ভুলে গেছে স্বচ্ছ জলের মানে। স্বচ্ছতা, তুমি কোন পুকুরের বউ?
গাছের ছায়ার ঘোমটায় কোন গাঁয়ে থাকো? তোমারও কি পেকেছে
একটি দুটি চুল, অকালে। অকালে মরে যাওয়া নদী, অকালে
ঝরে যাওয়া ফুলের শোকে আমাদের শোভাযাত্রা শেষ পর্যন্ত
পণ্ড করে দেয় বুনো মৌমাছি, সীমান্তের পাহাড়ি হাতির পাল।
অতঃপর গতিপথ পাল্টে হাঁটতে থাকা মরূদ্যানের দিকে;
গভীর নলকূপ, দিঘি এমনকি মজা পুকুরের গল্পও যেখানে
ভীষণ অচেনা। অচেনা ঠেকে স্ত্রীর কাছে স্বামী, পিতার চোখে
পুত্র, চেনা বন্ধুর মুখ; আর প্রেমিকার কাছে প্রেমিকের
হাত। বন্ধন ছেড়ে যাওয়া হাতেরা ফিরে না এলে পাশে
থাকে আহত প্রাতরাশ, এক পশলা বৃষ্টির মতো মুখ।
মুখের কি দোষ? মুখের নকশায় থাকে না সম্পর্কের নির্দেশনা।
বিশ্বস্ত গতিপথ। গতিপথ পাল্টানো নদীতে ভাসতে ভয় পায়
পেন্সিলে আঁকা কাগজের নাও। তাহলে তো কাগজই ভালো। তার
কাছেই অবমুক্ত করা ভালো গোপন বিস্ময়, আপসের আদালত।
তবে তো আপসই ভালো; সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তের সালিশে...
ভালোও তো আপেক্ষিক। সকালের ভালো সন্ধ্যায় পাল্টে যায়।
রাতের ভালো দিনের অপরিচিত। অচেনা কিছু মুখ তবু চেনা ঠেকে
দৃষ্টির আয়নায়। কিছু কথা, মুগ্ধতা কুয়াশায় আলো হয়ে জ্বলে
ডুবন্ত জাহাজের মাস্তুলে। কিছু মুদ্রাদোষ, তিক্ততা, ঘৃণা, অপমান
আলো হয়ে পিঁপড়ের মতো পায়ে পায়ে থাকে।
মুখোশের নৈকট্য ছেড়ে চলে যাই অন্য গোলার্ধে, যেখানে
প্রকৃত
মানুষ
বাড়ে
মনে,
গোপনে...
কদমতলার প্রার্থনা
মাঠের মাঝামাঝি একটি কবর
কদমের ছায়ায় অপেক্ষায় থাকে
জীবিত স্বজন এসে তুলবে প্রার্থনার হাত
বাতাস ও বৃষ্টিরাও যোগ দেবে তাতে
অদ্ভুত স্বস্তির যৌথ মোনাজাত
সমগ্র ছায়া মাটিতে পড়ে ভেঙে ভেঙে যায়
ঘাসের ফাঁকে পড়ে থাকে রোদ ও ছায়ার ইশারা
আলো-ছায়ার ভগ্নাংশে পড়ে থাকা ধান খুঁটে খেতে
খেতে আবাসিক চড়–ই ঠুকরে দেয় রোদের আলো
কখনো কখনো ছায়াকেও। জলে ভাসা খড়কুটোকেও
যেমন ঠুকরে দেয় ক্ষুধার্ত মাছ, খাদ্যের ভ্রমে।
নিজেকে এই আলো-ছায়ার শুভার্থী ভাবি,
সেখানে খুঁজি বহুকাল আগের বিচ্ছিন্ন মুখ
দেশভাগের শিকার মানুষ যেমন নতুন মানচিত্রে
করে ফেলে আসা শেকড়ের সন্ধান
কবরের ধার ঘেঁষে
পায়ে চলা পথ
গেছে গ্রামের দিকে
ও গ্রাম তুমিও কি বৃদ্ধাশ্রমে থাকো?
কবরের অধিবাসীর মতো অপেক্ষায়
পরবাসী সন্ততির?
দূরবর্তী বিমান,
পাখির উড়াল
দূর পথিকের হেঁটে আসা দেখলেই
মনে হয়-- প্রতীক্ষার বুঝি শেষ!
বৃদ্ধাশ্রমের সহযোদ্ধারা জানেন,
বিশেষ দিনেও তার কোনো সাক্ষাৎপ্রার্থী ছিল না।
প্রবল শীতেও ছিল না, ফোন বা চিঠির উষ্ণতা।
ছিল একটি ছবি, রুপার ফ্রেমে বাঁধানো,
চোখের জলে ভেজা, পারিবারিক।
অশ্র“র দাগ বুকে নিয়ে ছবিটিও প্রতীক্ষমাণ
একটি ছায়ার।
দীর্ঘ সে ছায়াটি
আজো আসেনি,
না আশ্রম
না কদমতলায়।
এবং ছায়া...
মুখের ভাপে পরিষ্কার করা চশমার কাচে
মরা শালিক হয়ে পড়ে থাকে গোটা জীবনের ছায়া;
ঝুলে থাকা বাদুড়ের উল্টো চোখে স্থাপন করি নিজেকে
দেখি-- স্থির কম্পাসে কাঁপে দিক হারানো নাবিকের দ্বিধা।
বালতির জলে ভাসা সূর্যগ্রহণের আকাশে মাতৃভক্ত পাখির উড়াল
তার সঙ্গে যাই পশুমেলায়। সেখানে সুদর্শন পশুর চোখের মণিতে
ওঠানামা করে সম্ভাব্য ক্রেতার কোলাজ, সই করা মৃত্যু পরোয়ানা।
আর আমার চোখে ভাসে কনের আসরে
পাত্রের চোখে স্থির কনের মুখ,
গুমোট অস্বস্তিতে ঘেমে ওঠা মুখের প্রসাধন।
হন্তারকের চোখে নিজের ছায়া দেখা মানুষের আতঙ্ক
ডিঙিয়ে ফিরি বর্ষার জলমগ্ন গলিতে। সতর্ক অভ্যস্ততায়
ইটের সাঁকো পেরোতে গিয়ে পায়ের কাছাকাছি সেই
শালিকের ছায়া। ওপরের বৈদ্যুতিক খুঁটিতে
যে বসে আছে, যার মৃতদেহ গেছে নাগরিক ডাস্টবিনে।
আত্মগোপন
আলজিভের নিচে লুকিয়ে থাকা তিল,
তোমার সৌহার্দে আস্থা ছিল খুব।
যখন শস্যকাল,
বেড়ে উঠছ তিলের সংসারে;
আরো সব যমজের সঙ্গে, খোসার ভেতর শুয়ে
আয়েশে বুজেছ চোখ, সূর্যস্নানে নামা তরুণী বা
মগডালের শীর্ষ পাতাদের মতো।
শীতের রোদ পোহানো প্রসূতির গর্ভস্থ সন্তানও
যেমন নড়ে ওঠে কিছুটা, তেমনি বাতাসে
দুলে উঠলে সমগ্র ডাল তুমিও উঠেছ নড়ে।
শস্যের মাঠে কৃষ্ণাঙ্গ ভাইবোনের সাহচর্যে
বড় হতে হতে ভাবলে আর নয় মিঠেপানির দেশ।
এবার নোনাজলে স্নান।
ঢেউয়ের তোড়ে ভাসতে ভাসতে
সামন্ত বজরা, পাল তোলা জাহাজের পিছু পিছু
দেশ থেকে দেশান্তর! কালো মানুষের প্রদেশ হয়ে
সাদা বরফের নদী। এক একটি দিনকে মেপে বছরের দৈর্ঘ্যে
তুষারপাতের নিচে পড়ে থাকা বহুকাল।
এই ফাঁকে কত কী বদলে গেল জলের!
পানিকে শেখাল মানুষ জমাট বাঁধার কৌশল।
পাল তোলা নৌকায় এলো কলের ইঞ্জিন।
নদীশাসনের গল্পেও লালচে মরিচা।
ঘুম ভেঙে পরাধীন জলের ক্রন্দন, তুষার বৃষ্টিতে শ্বেত ভালুকের
নাচ, হিমালয়ের বরফ গলা দেখতে দেখতে আবারো নামলে পথে।
চলতি পথেই ঘটে শস্যের প্রথম অপরাধ। সঙ্গী তিলকে হত্যা করে
পুঁতে রাখলে বরফে। কাউকে ভাসালে জলে। ভ্রাতৃহন্তারক হাবিল।
তারপর আত্মগোপনের দীর্ঘ দীর্ঘকাল;
কখনো মিশে গেলে মানুষের দেহের তিলে।
সাপের খোলসের মতো ছেড়ে কালো আবরণ বাদামি
ছবির ক্যানভাসে, সাদা ত্বকেও কী অদ্ভুত পরিপাট্য।
কখনোবা নেমে কয়লাখনিতে,
দোয়াতের কালিতে
নেয়ে আবারো ফেরা পুরনো চেহারায়।
কুয়োতলা থেকে
সান্ত্বনায় তোমাকে পাই স্বস্তিতে বেদনায়
অচেনা ঠেকে তবু জলে ভেসে ওঠা মুখের প্রতিচ্ছবি।
বৃত্তাকার দেয়ালে গজিয়ে ওঠা শ্যাওলার অভিমান,
নিচে নামতে নামতে গাঢ় হয়ে যায়।
জলে নামলে দেখাই যায় না।
চোখের সীমানায় থাকে বৃহৎ কলসের প্রচ্ছদ।
গলায় দড়ি বেঁধে কোনো বালতি তাকে খুঁজতে নামলে
উঠে আসে একবুক থই থই জল।
জলের ছদ্মবেশে হয়তো উঠে আসে সেই।
পুরনো অভ্যাসে মাজে বাসন-কোসন, কাচে কাপড়-কাঁথা।
পার্শ্ববর্তী বুজে যাওয়া যমজ কুয়োয় তার চাপা পড়া
ইচ্ছেরা জীবিত কুয়োয় বালতি পড়লেই কেঁদে ওঠে।
মধ্যরাতের দুঃখিত কুকুরের মতো?।
বাতাস তাড়ানো শুকনো পাতারা পথ ভুলে
কুয়োয় পড়ে লাশের মতো পচে-গলে উঠলে,
কেউ কেউ ছুড়ে দেয় দু’একটি লেবুপাতা,
সুগন্ধি ফুল, আতরের ফোঁটা।
এইসব শুশ্রুষায় কি ঢাকা যাবে
বহুকাল আগের সেই দূষিত জলের ইতিহাস?
তারচে’ বরং ভেতর থেকে তুলে আনা যাক
সেই অষ্টাদশী কঙ্কাল। ব্যবহারের পর
খাকি পোশাকেরা যাকে ফেলে দিয়েছিল
নিংড়ানো চা পাতার অবহেলায়।
যুদ্ধফেরত স্বাধীনতাও যাকে উগরে দিয়েছিল পরিত্যক্ত বমির ঘৃণায়।
গতিপ্রবণ বন, বিড়াল ও লাল বলের গল্প
হামাগুড়ি দেয়া একটি শিশুর সঙ্গে
সারাবেলা খেলা করে একটি লাল বল!
তুমি কি সেই ঘরের অধিবাসী?
প্রতিসন্ধ্যায়
যার চৌকাঠে কুর্নিশ করে
এক অন্ধ বিড়াল।
লাল বলের জন্মদিন
বিড়ালটি উপহার দেয় গায়ের পশম।
শিশুটি মায়ের কাছ থেকে কোনো উপহার আদায়ে অসমর্থ হয়।
বলের বিক্রেতাও পুত্রের জন্মদিনে কিনতে ব্যর্থ পছন্দের লাটিম।
এইসব অনুতাপ, ক্ষোভ রাজহাঁসে পরিণত হলে
শিশুটি সেই রাজহাঁসের সঙ্গে খেলতে নামে।
রাজহাঁস, বিড়াল ও শিশুটিকে নিয়ে
লাল বল যায় প্রতিবেশী মাঠে,
এক সময়ের এই বধ্যভূমিতেই,
এক পূর্ণিমায়, বৃষ্টিস্নাত
গাছের আলো-ছায়ায় বিড়ালের জন্ম।
বৃক্ষ, তুমি কি ভিনদেশী সেই বনের প্রতিনিধি
ভয়াবহ দাবানল পেরিয়ে শীত পাখিদের পিছু পিছু
প্রাচীন ধর্মপ্রচারকের মতো এখানেই বিবাহ, সংসার।
তুমি কি সেই নারীর প্রতিনিধি, কাঁকনের বাহানায়
দু’হাতে জড়িয়ে রাখে সুতানলি সাপ?
ছায়াপ্রবণ একটি বন
পাতা ঝরাতে ঝরাতে
হেঁটে যায় নদীর দিকে।
ভাসমান রাজহাঁসের পিঠে হাসছে
এক শিশুযাত্রী;
পাতাকুড়ানি মায়ের সতর্ক চোখের পাহারায়।
প্রিয় বৃক্ষ, নারী ও শিশু, তোমরাও কি জেনে গেছ
মানুষের চেয়ে জলের আস্থাই অধিক নিরাপদ।
সব দুঃখই তো এক সময় জল হয়ে ঝরে।
যাত্রা
চার বেহারার কাঁধে চড়ে কে যায়?
কাকে তারা পৌঁছে দেয়?
বেদনার্ত অনিচ্ছায়, সমাধি আখড়ায়।
সেকি আমি, নাকি সেই প্রাচীন বেহালাবাদক
বহুকাল থেকে থেকে দাফনের অপেক্ষায়
রয়েছে শুয়ে ফসিলের অবয়বে।
অথবা আমার সেই বোন, বহুকাল আগে যে
এসেছিল। এ কেমন জন্ম? পৃথিবীতে এসেও
দেখা হয়ে ওঠে না রঙ, রূপ, আলো।
পিতা-- মাটি খুঁড়ে দেখা প্রথম সন্তানের মুখ।
অশ্রুসিক্ত বাতাস ও ঘাসের বেদনাকে ছুঁয়ে যায়
শোকার্ত প্রজাপতি।
যেন কে বলেছিল এসব-- কৈশোরের পাড়া বেড়ানো
দিনে, নাকি সেই ব্যাঙমা ব্যাঙমির আলাপি ঠোঁট থেকে
পানের পিক হয়ে পড়েছিল ঝরে।
শববাহকের আড়ষ্ট পা যেন মাড়িয়ে না যায়
কোনো ব্যথিত পিঁপড়ের ছানা।
কেন যেন হঠাৎ নিভে যায় পিলসুজে রাখা মাটির প্রদীপ।
আয়ুর উষ্ণতায় একটু একটু গলে যায় মোমের শরীর।
বহুদিন ভুলে আছি বিবাহিত ঘুম
এত বছর পরও খুঁজে পাওয়া যায় হারানো বাদামের খোসা!
ভেতরে মাতৃস্নেহে আগলে রাখা সম্পর্কের বীজ।
অনাথ পেন্সিল এক, কত সমুদ্র জল পেরিয়ে শেখে
সব জলমহালের গল্পেই থাকে নিষিদ্ধ গন্ধমের অনুতাপ।
মুমূর্ষু বনসাইয়ের জন্য অনুতপ্ত এক কাক নিয়ে আসে
নিজের একপাটি ঠোঁট। দমিয়ে রাখা এই অশ্বত্থের
পূর্বপুরুষের ডালেই যে কয়েক পুরুষের বাস।
তবে যে দেরি হয়ে গেল খুব!
শীতের অপেক্ষায় থাকা কুয়াশার মর্মবেদনা দেখতে
দেখতে হঠাৎ জেগে ওঠে বহুদিন ভুলে থাকা বিবাহিত ঘুম।
পলিশ করা জুতার চাকচিক্যে হেসে ওঠে
কয়লা খনিতে পাওয়া হীরের গল্প।
জল...
অবেলায় স্নান করতে আসা নারীর শাড়ি থেকে
চুইয়ে পড়া জলের সূত্রে দেখা তার সঙ্গে।
অন্ধ ভিখারির একমাত্র মুদ্রা পকেটে পুরে
হাঁটা এই তস্করের পিছু নেই।
পথে পথে দেখি ধুলো ভাঙা পায়ের পর্যটন
নখের ময়লারাও চায় মুক্ত জলের স্নান
পিঠে মুদ্রিত অযত্নে থাকা চুলের নালিশ।
ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ জোড়াতালি দিয়ে বানানো
বাড়ির শামিয়ানা। মেঘের জলভরা চোখ
কবে কোন আষাঢ় থেকে চেয়ে আছে পথ,
পরিত্রাণের।
পথে পথে চুইয়ে পড়ছে জল
বহুদিনের তৃষ্ণার্ত ধুলো তা তুলে নিচ্ছে ঠোঁটে।
অগ্নি, কাঠ, দিয়াশলাই
এত যে প্রাপ্তি; তার ফাঁকেও শূন্যতার হাট,
দেয়ালে গেঁথে থাকা বেদনার ইট।
সিমেন্টের প্রলেপের আড়ালে তার দীর্ঘশ্বাস শুনতে পায়
কার্নিশে গজানো বটের চারা।
একটু পানি পেলেই যে বর্তে যায়।
চাতকের অপেক্ষা শেষে যেন জলের অভিবাদন।
এই চারার উচ্চতাকে কুর্নিশ করে পাতার নিচে
ঠাঁই নেয়া ক্ষুদ্র প্রাণীদের অনেকেই মিশে গেছে লোকালয়ে।
মিশ্র মানুষের হাটে, সেই কাঠবিক্রেতার দেখা পাই।
সব শূন্যতা মিশিয়ে কাঠে থাকে বসে।
পোড়ালে সে কাঠ বিভিন্ন রঙ হয়।
সম্পন্ন, দরিদ্র, অভিজাত,
নানা বাড়ির আগুনে নানা রঙ-- নীল, হলুদ, সাদা।
আগুনের এত এত রূপ কবে আর দেখেছে মানুষ?
বিস্ময় যখন কাটে তখন ভোর।
ভোর পেরোলেই আবারো কাঠের সওদা।
শত শত ঝাঁপি নিয়ে একজনই বিক্রেতা,
হলুদ আগুনে যার সব পুড়েছে;
ঘর, শস্য, গোলা, সন্ততি।
ছাইয়ের স্তূপ থেকে জন্মানো
এক বিস্ময় বৃক্ষেই জীবিকার ছায়া।
পঙ্গপালের মতো বেড়ে ওঠা ডালপালা
যেন ছায়া দেবে গোটা গ্রাম।
কাঠের ঘর্ষণে জ্বলে আগুন,
যেভাবে পোড়ে বন, গাছ, গ্রাম;
কথার অগ্নিতেও পুড়ে লাল
সম্পর্কের সব কাঁচা ইট।
তার মুখ থেকেও ঝরে অগ্নি,
লাল, নীল, বেগুনি।
ঘর, গ্রাম পোড়ানো সর্বনাশা আগুন;
দয়ালু বা নির্দয়।
আগুনের সেই গ্রামে গিয়েছিলাম আমিও।
বিভ্রমে, কৌতূহলে, দীর্ঘ সারিতে দাঁড়িয়ে
কিনেছি এক ম্যাচবাক্স।
বাড়ির পুরনো এক পেন্সিল সে বহুরূপী আগুনে কখনো পোড়েনি।
পাখিনামা
হারানো পাখির খোঁজে যাই বনে।
বন মানে প্রজাপতি, নতুন কুঁড়িতে প্রথম রোদ,
গাছের কোটরে নরম পোকার ঘুম
খঞ্জনার বাসায় জোড়া শালিকের ছা।
পাখির বাসায় রেখে আসি বাড়ির ঠিকানা,
ছুটে যাই সেই চিঠিঘরে।
যেখানে পোস্ট করার কথা কিছু প্রতিশ্রুতি
অভিযোগ, যদি সে পাঠায় সব গান।
পুরনো সুর, নীল খামে।
ফিরে এসো পাখির পালক, জানালায়, ঘুলঘুলিতে
রেখে আসা ঠিকানায় এখন নেই আর
নতুন বাসাটাও পাখিবান্ধব, বড় ঘুলঘুলি প্রশস্ত বারান্দা।
পাখির গানের সেই সিডিটি হারিয়ে গেছে বাসা বদলের ভিড়ে।
কত যে পাখি, কত রকমের গান। ফিঙে, শালিক, টিয়ে।
কোথায় যে হারিয়েছে এসব মিঠেসুর!
প্রান্তিক শিক্ষার্থী
তুমি কি বৈশাখ মানো?
রোদ, ঝড়, জলের পদাবলি!
মানো-- সানস্ক্রিনের বর্ম পেরিয়ে
ত্বকে সুচ ফুটানো প্রখর জ্যৈষ্ঠ।
শরৎ মানলে কাশফুলও মানা চাই
স্বীকার করে নেয়া চাই তুলোট মেঘের বারতা।
মানো প্রেম? নৈকট্য?
তাহলে স্বীকার করে নিতে হয় পর্যাপ্ত বিরহ।
দুধ থেকে মৃত মাছি তুলে নিতে নিতে
তার তৃষ্ণাকেও সত্য মনে হয়।
পরাজিত জল হয়ে নয়-- যদি পারো
শিশির হয়ে স্থির বসে থাকো কচুপাতায়।
আন্দোলিত বাতাস যাকে কুর্নিশ করে ফিরে যাবে।
এই গল্পের অক্ষর লিখে লিখে স্বাক্ষরতা শিখবে
নৈশ স্কুলের প্রান্তিক শিক্ষার্থী। ঝরা পাতাদের
সঙ্গে যারা ঝরেছিল স্কুলের খাতা থেকে।
কোর্ট মার্শাল
অপরাধের চেয়ে বড় হয়ে গেলে সাজা,
আকাশ থেকে ঝরে মধ্যাহ্নের বরফ
উচ্চাভিলাষী তিল পরিণত হয় তালে।
তারপর নামে জলে, বিরল জ্যোতিষীর খোঁজে।
যার সব কথা, তসবির গোটার মতো কঠিন,
গোলাকার সত্য হয়ে যায়।
যতটা গোলাকার পৃথিবী : যতটা কঠিন জীবন।
হেলেদুলে চলা লোকাল ট্রেন বুক-পিঠের সব যাত্রী নামিয়ে
শেষ স্টেশনে যখন বিশ্রামে থামে, স্টেশনমাস্টারের
চায়ের কাপে স্বেচ্ছায় ডুবে যায় এক তৃষ্ণার্ত মাছি,
মৃত্যুর আগে সেও শোনে সেই রোদের কাহিনী;
ভোররাতে আদালতপাড়া, জেলখানা, ফাঁসির মঞ্চ ঢেকে যায়
প্রখর আলোতে, এই আলোর সঙ্গে সন্ধি করার আগেই নড়ে
ওঠে একটি রুমাল, জল্লাদের হাত। সে হাতের তালুতে থাকা
তিল এই হত্যাকাণ্ডের জন্য তাকে কখনোই ক্ষমা করেনি।
অলৌকিক সেই রোদের কাহিনী যারা শুনেছে, তাদের
সবার কবরেই জন্ম নিয়েছে কোনো না কোনো ফলের গাছ।
ক্ষুধার্ত মানুষ ও পাখিরা জানে না সেসব ফলের জন্মকথা।
অপরিশোধিত ঋণ, ছায়ার কাছে
চাদের আলোয় নিজের ছায়াকেও
মনে হয় অন্য কোনো জন,
পাশাপাশি চলছে পথ
রক্তের মতো ছায়াদেরও একই রঙ।
মানুষের মতো ছায়ারাও অসুখী, একাকী।
পুত্র পরিত্যক্তা ছায়ারা বৃদ্ধাশ্রমে থাকে,
অবিবাহিতা, স্বামী পরিত্যক্তারা নারীনিবাসে।
দুই ভবনের ছাদ একই আকাশের শিষ্য বলে
এসব ছাদে আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে উড়ন্ত পাখিদের ছায়া।
নকল মানুষের ছায়া গুনে গুনে হয়রান পাখিরা বলে,
ডানায় বেঁধে দাও কিছু তাবিজ, বেঁধে আসি বলিষ্ঠ ডালে,
তারা মানুষের অবয়বে ছায়া হয়ে যাবে।
পরস্পর গল্প করতে করতে কোনো গাছ, পাখি দেখে--
তাদের ছায়ারাও আলাপে মশগুল।
পথে পথে দেখি মৌন, আনন্দিত, শোকাহত,
ক্ষতিগ্রস্ত ছায়ারা হেঁটে যায় ব্যস্ত, শ্লথ, মন্থরগতিতে।
এভাবে আড্ডায়-গল্পে-আলাপে মানুষের ছায়ারাও
নিকটবর্তী হতে হতে সরে যায় দূরে।
এসব দূরত্ব, নৈকট্য, নিঃসঙ্গতা, কোলাহলের ফাঁকে,
নিষিদ্ধ ছায়াপল্লীতে আসা-যাওয়া বাড়ে অবিশ্বস্ত ছায়াপুরুষের।
অবসরে মায়ের কোলে শুয়ে একটি শিশুছায়া শোনে মশাদের
কাকর নিক্ষেপে অতিকায় হাতিদের নাস্তানাবুদের কাহিনী।
যেসব হিংসুক ছায়াসঙ্গী ছিল আমার,
ভেতরে সেই পুরনো কঙ্কাল,
অথচ বন্ধুর মতো হাসে।
সেই বৃদ্ধ ছায়াটাকে এখনো খুঁজি,
বৈশাখের এক দুপুরে যার কাছ থেকে কিনেছিলাম বেতের ডালা।
ভাংতি না থাকায় যে পয়সা নেয়নি। বলেছিল-- বিকেলে দিলেও
চলবে। বিকেলে যাকে আর খুঁজেই পাওয়া যায়নি।
আরো একটি ছায়াকে বহুদিন দেখি না।
প্রখর মধ্যাহ্নে যাকে আরো দীর্ঘ মনে হতো।
ঘুমে আক্রান্ত মেঘনার পাড়
মানুষের পিছু নেয়া এক সাপ
অথবা সাপের পিছু নেয়া এক মানুষ
একাকী চলছে পথ
দেখে নেয়া ভালো সাপের মণিতে আছে কি-না
পর্যাপ্ত আলোর মজুদ! তাকে না আবার পৌঁছে দিতে হয়
ফিরতি পথে সদ্য ছাড়া খোলসের কুণ্ডলিতে
মনসার কাছে নত হওয়া পিতার জেদ
পুত্রস্নেহে উড়ে যায় মেঘের প্রদেশে
কিছু প্রেম অহংয়ের জলে নেয়ে বর্ষণের জন্য বেছে নেয় বৃষ্টিগ্রাম
বৃষ্টিস্নাত আলুথালু পথে, পায়ে পায়ে
বা বুকে ভর দিয়ে কে যে পিছু নেয় কার?
সেই মাঝি, নায়ের গলুইয়ে বসে নিজেকে বাজায়,
ভরা পূর্ণিমায়--নদীর কূল নাই কিনার নাই রে...
যদি সে মুখোমুখি হয় পূর্ণ ফণার, ঘুমে আক্রান্ত মেঘনার পাড়
লাফিয়ে পড়বে না জলে, হ্যামিলনের আত্মঘাতী ইঁদুরগুলোর মতো;
দৌড়ের প্রস্তুতিতে বাড়াবে না পা, ধুলোমাখা, নতুন চরের পলিতে ভেজা,
ফাটা গোড়ালির মধ্যবয়সী পা তার বয়সের সৌন্দর্যকে আত্মসাৎ করেছে কবেই
যদি সে দংশিত হয়! কিছুই এসে যায় না, ইতোমধ্যে সে স্বীকার করেছে
মানুষের দংশন, আত্মস্থ করেছে এক জীবনের সব গরল
দৌড়
আমি সেই মেঠো ইঁদুর,
বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বেঁধে
ফিরে এসেছি অক্ষত।
পাড়া বেড়ানো বিড়াল, যে পতাকাকে ভাবে শীতবস্ত্র এক
ঘণ্টার শব্দে কর্পূর হয়ে উড়ে যায় রাতদিন বিকেলের স্বস্তি
শিশুর কোমরের কাইতনে বাঁধা ঘুঙুর,
ঝড়ো বাতাসে বেজে ওঠা মন্দিরের ঘণ্টাও অনেক শান্তিপ্রিয়
তার বিপরীতে এই আওয়াজ বড় বেশি উৎপাতমুখর।
শব্দদূষণ বিপদসীমা পেরোলে সে নিয়োজিত হয় প্রাথমিকের
দপ্তরির পদে। গুনে গুনে বাজাবে কাঁসার ঘণ্টা, প্রতি ক্লাসের
বিপরীতে, শেখানো হয় ছুটি ও বিরতির তফাৎ।
স্কুলমাঠের চোরকাঁটায় মোজা ও হাঁটু অবধি প্যান্ট গেছে ছেয়ে।
কী বিস্তৃত এই দৌড়! পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ।
টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া; শহরের এমাথা থেকে ওমাথা,
ঘুরতে ঘুরতে মাথায় দৌড়ে যায়
শূন্য থেকে আজ অবধি মানবিক ভ্রমণ।
শিউলি তলায় পড়ে থাকা চুপসে যাওয়া ফুল কুড়োতে গেলে
বিড়ালটি হঠাৎ তেড়ে আসে, মাথাচাড়া দেয় পুরনো রাগ।
আমিও দে ছুট। ছুটি ভেবে শিশুরা বাড়ির পথ নেয়।
দিন মাস বছর পেরিয়ে পিছু ফিরে দেখি--
বিড়ালটির পিছু নিয়েছে এক পাগলা কুকুর।
দক্ষিণদুয়ারী বাড়ির জানালায় বসে..
যতটুকু গেলে ফিরে আসা দুষ্কর,
ততটুকু দূরত্ব খোয়া গেছে পথেই।
তবু খুঁজে ফেরা পথের দৈর্ঘ্য
পথ আগলে দাঁড়ায় পোষা কবুতরের ছায়া।
এই কি গন্তব্য, এখানেই কথা ছিল আসার?
মুদ্রার পিঠে আঁকা শাসকের ছবির স্থিরতায় আটকে থাকে
পূর্ণদৈর্ঘ্য জীবনের ফিতে। ও মুদ্রা যে টাকশালে জন্ম,
তার ভবন কি দক্ষিণমুখী? তার পাহারায় কি আছে
একটি দুটি অবৈতনিক বৃক্ষ দাস?
দক্ষিণদুয়ারী এক বাড়ির স্বপ্ন মায়ের চোখের প্লাবনে
পথ হারিয়েছে কবেই। আরো কিছু খুচরো বেদনার
আধুলির মতো একেও বেঁধে রাখেন আঁচলের খোটে।
পুরনো সিন্দুকে হাতড়ে বেড়ানো প্রত্নতাত্ত্বিকের হাত যেমন
হিমশিম খায় গুনতে মুদ্রার বয়স। আমিও তার সফেদ চুলের
পরিমাণ গুনতে গুনতে ভাবি, বরং এর চেয়ে সহজ সংখ্যালঘু
কালো চুলের শুমারি। বলিরেখা পড়া ত্বকের ভাঁজে শুশুকের
মতো সহসাই গুম হয়ে যায় শৈশবে দেখা সেই মুখের লাবণ্য।
বর্ণান্তরিত বিড়ালের অভিশাপ
পর্যাপ্ত ঘামের পর মধ্যাহ্নে সব পাখির জ্বর সেরে গেলে
মাঠে মাঠে বেজে ওঠে শস্যসঙ্গীত।
ঘর্মাক্ত পালকের একটি পাখি, খাঁচার কোণে ঝিমুতে ঝিমুতে
পুরনো অভ্যস্ততায় শোনে প্রৌঢ় দম্পতির কলহ। স্ত্রী এক
জীবনের সব ক্রোধ উগরে দেন প্রতিপক্ষের পায়ে।
সেই যে বাড়ি, পিতা মাতা সন্তান, সেই যে বিড়াল, তুলতুলে, শুভ্র,
গৃহকর্তা বাড়ি ফেরার পথে এগিয়ে আসা পায়ে পায়ে। এ কি মমতা!
নাকি পকেটে থাকা বিস্কুটের লোভ, প্রতিদিন যা বরাদ্দ তার জন্য!
সেই যে বিড়াল, এক সোফাতে বসা, এক বিছানায় ঘুম,
পায়ে পায়ে বেড়ানো সেই পোষা প্রাণী রেখে বাড়ির ছোট মেয়েটি
যেদিন পড়তে গেল বিশ্ববিদ্যালয়ে, সেদিনই কপাল পুড়ল তার।
এঘরে ওঘরে সে খুঁজে ফেরা মানুষের মুখ, স্পর্শ। ঘর, বিছানা,
হেঁসেলের হাঁড়িতে। উৎপাতে উৎপাতে কমে আসে স্নেহের পারদ।
একসময় পুরোপুরি উড়ে গেলে বস্তায় ভরে তাকে ফেলে আসা হয়
দূরের মাঠে। সেবার পথ চিনে ঠিক ফিরে এলেও একদিন আর
ফেরা হয় না। ছুটিতে বাড়ি ফিরে মেয়েটি দেখে শূন্য ঘর, আঙিনা।
সেই যে বিড়াল, তার অভিশাপ কি আজো ঘিরে আছে তাদের?
বাড়িবদলে যা স্থানান্তরিত হয়েছে নতুন আবাসে। অথবা
বর্ণান্তরিত হয়ে উড়াল কোটাতে ফিরে এসেছে পাখির অবয়বে।
মাঠ বিষয়ক
হাজারো ঘাসের মৃত্যু হলে জন্ম নেয় একটি মাঠ
প্রথম শিশুর সঙ্গে যেমন জন্ম হয় মায়ের
পায়ে পায়ে ধুলো, পায়ে পায়ে বল; ও মাঠ,
প্রতিটি ম্যাচের পর তুমিও কি ক্লান্ত হও? পরাজিত
দলনেতার মতো তোমার কাঁধেও বসে থাকে বিষণ্ন সারস!
অধিক পদভারের ধুলো ওড়া ক্লান্তিতে দয়ালু আকাশ
মেলে ধরলে এক পশলা শীতল বর্ষণ, সতেজ হয়ে ওঠো
সদ্য স্নান সারা মানুষের মতো?
ধুলোমাখা বুকে মজুদ কত কত পায়ের জলছাপ!
পায়ে পায়ে ধুলো, পায়ে পায়ে বালি
ধুলোতে মিশে যায় জং ধরা পায়ের মরিচা।
এসব মরিচা জলে মিশে আরো বেশি
ভরাট করে তোলে নদীর তলদেশ।
ঈদের জামাতের পর নামাজীর হারানো জুতার একপাটি
কিংবা বালকের আধুলি এখানেই কুড়াতে আসে উৎসাহী টোকাই।
উড়াল পরিবার
ক
দেয়ালে দেয়ালে ওড়ে প্রজাপতির ছায়া, কয়লায় আঁকা পাখি;
পেন্সিলে আঁকা বনে আছে ডালপালা কিছু, অগ্নির আয়োজন।
অগ্নি সাক্ষী রেখে বিয়ে করে প্রজাপতি ও কয়লাপাখি
তাদের উড়াল পরিবার ভালোবাসে পাখার সমতা।
এই সম্পর্কের পর প্রজাপতির সংসারে রাঁধতে বাড়তে,
খেতে পরতে পেয়ে ছায়া এমনকি পাখিও প্রজাপতি
হয়ে যায়। দেয়ালে খুঁজে পওয়া যায় না পাখার অস্তিত্ব।
খ
পর্যাপ্ত ইট নামিয়ে গলির ট্রাক চলে গেলে
মধ্যরাত আবারো শ্বাস নেয় ঘড়ির কাঁটায়
দেয়াল হাতড়ে সেই টিকটিকিকে খুঁজি,
খসে পড়া লেজের শোকে বহুদিন নির্ঘুম;
বাড়ির সব দেয়াল যে বেদনার ভার বইতে বইতে রক্তাক্ত।
প্লেটভর্তি ঘুমের অর্ঘ্য ডুবে যায় পিপাসার জলে।
কাঁসার থালাতে যত মেদ চকচক করে তেঁতুলের ক্বাথে।
চিনেমাটির কাছে পরাজিত এই সৌন্দর্যে
এখনো রয়েছে পর্যাপ্ত মনোবল
শুনেছি ওড়ার অধিকারে খাঁচাখোলা পাখিরাও
করবে নিজস্ব বনের পত্তন। টবের শৃঙ্খলা থেকে মুক্ত
বনসাই ফিরে পাবে প্রকৃত মাটি, পূর্ণদৈর্ঘ্য উচ্চতা।
ওড়ে ছাই, উড়ো হাওয়ায়
তোমার যে বোন সেবার
জলপাইপাতাকে নিয়ে সমুদ্রে গেছে
ফিরেছে আমলকী হয়ে
ঘরপোড়া গরুদের যতই বলি-- ভয় নেই সিঁদুরে মেঘে,
তাদের চোখে তবু অগ্নির প্রসঙ্গ; ভয়াবহ দাবানল।
ভেতর ও বাইরের সব আগুন থেমে গেলে সংগৃহীত ছাই নিয়ে
পথে পথে চলে বিজ্ঞাপন-- ছাই নেবেন ছাই?
নেব, আরো নেব ছাইয়ের পূর্বপুরুষ,
শেকড়, ডাল, পাতার সাশ্রয়ী প্যাকেজ;
যেসব ডালে কোনো পাখিই বসেনি, বজ্রপাতে মরেছে যে,
আর ফুল-ফলহীন গাছের গল্পগুলো বহুতল ছাদ থেকে
নিচে পড়তে পড়তে তৈরি করবে নিজস্ব ছায়া, মাটিতে পড়ার
আগেই সেগুলো কুড়িয়ে আবারো পথে নামবে কোনো বিক্রেতা;
যার হকার জীবনের সব অধ্যায় জ্বলে পুড়ে অপাঠ্য হয়ে গেছে।
জলপাই বন ও আমলকীর ডালে শুনেছি
কোনো পাখিই আর বসতে চায় না।
ইচ্ছেঘুড়ি
ইচ্ছেঘুড়ি, কতবার তুমি উড়েছ স্বেচ্ছায়?
গাংচিলের ডানার সমান্তরালে কতবার পেয়েছ মেঘমুক্ত আকাশ।
তুমি কি সেই বকের সহপাঠী, মাছের ধ্যানে একপায়ে
দাঁড়িয়ে থাকা শাপলাবিলে; সেই দুপুরের মিত্র,
দূরের কয়লাখনি থেকে যার পত্র এসেছে;
মৃত সেই রেশম পোকা, যার অভিশাপ লেগে আছে সিল্কের জামায়?
সেদ্ধ শালুকের বুক, কালচে খোসার আড়ালে হলুদ ঘুম!
খসখসে বাকলের নিচে কাঠের উজ্জ্বল, মসৃণ হাসি,
পাকা ফসলের মাঠ, অগভীর দিঘি বা নদীর জলে ছায়া ফেলে
খুব নিচু দিয়ে উড়েছ কখনো, অথবা ছায়া পড়ে না এমন উচ্চতায়,
ঈগলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে, দীর্ঘ সারিতে ওড়া শীত পাখিদের
কালো রেখার পিছু পিছু গ্রাম পেরিয়ে ঢুকেছ নগরে?
দেখেছ বহুতল ছাদে ডানা মেলে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ এন্টেনা
পরিত্যক্ত জুতায় বাসা বাঁধা ইঁদুরের সংসার?
বাতাসে সিসার ঘনত্বে নিয়েছ নিঃশ্বাস!
নৌকাবাইচের বৈঠার আঘাতে কুঁকড়ে যাওয়া জলের আর্তি
এখনো কি আছে মনে, মরুভূমির নিচে চাপা পড়া
প্রত্ননগরের ঘুম। বালির স্লেটে উটের সঙ্গে লেখা সে নাম?
অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে যাওয়া ভবনের ওপর দিয়ে উড়তে গিয়ে
পাখিদের সঙ্গে খুইয়েছ লেজের ভগ্নাংশ,
পোড়া লেজ নিয়ে বালকের হাতে ধরা পড়ে তার হাতের ইশারায়
নাচতে নাচতে এখনো কি আটকে আছো বৈদ্যুতিক খুঁটিতে!
পরিত্যক্ত বৈঠার অবকাশ
মাথার তালুতে চুলের স্বাক্ষর,
অনুলিপি পৌঁছে দিও নখের কাছেও।
পৌঁছে দিও হাতের আঙুল বান্ধব নদীর কাছে, তুলে নিও
সব দাবি, অভিমানের শিকড়। আর যত কালো বিড়ালের গান,
ফুল তোলা রুমাল, বেলা-অবেলার যেসব গল্প
বিক্রি হয়ে গেছে খবরের কাগজের সঙ্গে, মুড়ির ঠোঙায় ফিরে
এলে তুলে দিও ফিরতি ডাকে। এসব কথা লেখা ছিল মাঠে মাঠে...
সে এক অদ্ভুত সবুজ...
সবুজ মাঠে আবিষ্কৃত গুড়ের খনি বাড়িয়ে দেয় ডায়াবেটিক আক্রান্ত
পিঁপড়ে শ্রমিকের মর্মবেদনা। এসব শুনে শুনে
হাওরের তীর্থযাত্রীরাও সমঝে চলে আকাশের মেজাজ।
সে এক অদ্ভুত নীল...
যেখানে সব সমাপ্তি ভিড়ে যায় ঝরাপাতাদের দলে,
হাওয়ায় ওড়ে ক্লান্ত পাণ্ডুলিপি, অবিক্রীত গ্রন্থের পাল,
নির্ভার চিনেবাদামের খোসা
বড় দীর্ঘ সে পথ...
যে পথের শেষ কিস্তিতে এসে পিতা হয়ে ওঠেন পরিত্যক্ত বৈঠা।
খরস্রোতা জলে একদিন যার শাসনে ছিল নিষ্পাল নৌকার গতি।
ধীরগতিতে ওড়ানো ঘুড়ির লেজের দৈর্ঘ্যে বাড়ে পুলক, বিস্ময়
সে পুলকে চোখেই পড়ে না ক্র্যাচের ভরে হাঁটা পিতার মুখের বলিরেখা
সে এক অদ্ভুত রেখা...
দুই দুগনে পাঁচ
বৃষ্টিমুখী চাতক ও মানুষের প্রার্থনা একাকার হলে
শুভেচ্ছা সফরে আসে মেঘের বহর, চোখের প্রদেশে
জলের খনি ইজারা চায় বহুজাতক চাতক
ব্যক্তিগত মজুদ ভবনে খুঁজতে গিয়ে স্বস্তির বৈঠা,
দেখি জলে ভাসা নাও এগিয়ে যায় পালের প্ররোচনায়।
আমি শুধু থাকি পড়ে, পাঠশালার ঝরে যাওয়া
শেষ ছাত্র কুয়াশায় ভাঙি পথ, হাতে আসে কাশফুলের সান্ত্বনা।
শস্য বৃষ্টির প্রত্যাশায় পাথর, বরফ, এমনকি এসিড বৃষ্টির
কথাও কানে আসে, তবে তো খরাই ভালো, দ্বৈততা নেই;
প্রকাশ্যে বলে পোড়াতেই এসেছি-- বর্ষণের বিপরীতে।
এদিকে অগ্নিরোদের নেই শীতসকালের কোমলতা,
তবে কি সে জল্লাদ, পিতৃহন্তারক ইডিপাস, অথবা
মৃত্যুকে হাতে নিয়ে লড়া রণযোদ্ধা। শুনে শুনে
তারাও তো ভালোবাসে শিশুর প্রথম কান্না।
অন্ধ বিড়ালের লেজে পা পড়লে কেঁদে ওঠে বুক
কিংবা সেই গোরখাদক মনের অজান্তেই খুঁড়ে রাখে
নিজের কবর। অথবা সেই চণ্ডাল নেশায় বুঁদ
হয়ে নির্বিকার অভ্যস্ততায় ফাটিয়ে দেয় মৃতের মস্তক।
চাষাবাদ
পর্যাপ্ত গোপনীয়তায় কিছু বীজ পৌঁছে যায় বনসাই গ্রামে।
যার জন্য কৃষক অনাবাদি রাখে সমগ্র মাঠ।
ঘূর্ণায়মান পাখারা যেভাবে অবরুদ্ধ বাতাসকে ছড়িয়ে দেয়
স্বেচ্ছাশ্রমে কেটে নিন্দার পাহাড় নিন্দুক যেভাবে প্রতিটি টুকরো
ছড়িয়ে আসে এখানে সেখানে, সেভাবে এই খবরও প্রচার হয়ে যায়।
প্রচারিত হয়-- ভোরের মাঠ থেকে সংগৃহীত শিশির, যে গ্লাসে গ্লাসে
করে জলের অভিনয়, সে জলে এই বীজ, একরাত ডুবালে
অংকুরিত হবে। এই জল খাবে এক বৃদ্ধ,
সন্তানের আশায় যে একের পর এক বিবাহে জড়িয়েছে।
খরাক্রান্ত জমিতে পোতা হলে সেই বীজ। রেললাইন ধরে ছুটে
আসে দ্বিমুখী নিঃসন্তান অজগর। শালুকগর্ভা এক শাপলাবিল
সন্ন্যাসী বকেরা যেখানে স্বেচ্ছায় ধরা দেয়,
সে তার সব জল অনুদান দেয় এই চাষে।
বৃক্ষহীন গ্রামের পাখি ও মানুষেরা ভাবে তাদের রোদে পোড়া
পিঠ ও কষ্টে পোড়া মন পাবে প্রকৃত বৃক্ষের ছায়া।
অবশেষে আবারো সব গাছ বনসাই হয়ে গেলে আশাহত
মাটি ও মানুষেরা ধোঁয়ার কুণ্ডলী হয়ে গৃহত্যাগী হয়।
বহুদিন পর ফেরে নতুন কৃষিকৌশলে।
মানুষের মতো প্রকৃত বৃক্ষেরও চাই বেড়ে ওঠার স্বাধীনতা,
বায়ু, জল, আলোর পরিচর্যা।
প্রতিটি মানুষই এক একজন ব্যর্থ সহিস
রোলটানা পাটিগণিতের খাতা,
তোমার কাছেও আছে কিছু ঋণ
কবে কোন ছুটির দুপুরে কাঁঠাল মুচিকে দেখিয়ে নখের ক্ষমতা,
কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি কুড়ানো লাল দিনে, কোমল পাপড়িতে যুদ্ধ
বাধাতে বাধাতে তোমার বুকে কাটা একটি দুটি আঁচড়।
অন্তমিলে সাজানো কিছু শব্দের খসড়া, প্রাথমিক তুষ,
আবেগের দিয়াশলাই নিজ হাতে ছোড়া পেন্সিলে
আঁকা খড়ের গাদায়, স্বরচিত আগুনে পোহানো
শীতের উত্তাপ। চোখের সঙ্গে জাগিয়ে রাখা তোমাকেও।
তোমার মলাটে জমা ধুলোর প্রলেপ মুছে দিতে দিতে ভাবি
কিছু বিষ কীভাবে যে মিশে যায় পাস্তুরিত দুধে!
তবে কি প্রতিটি মানুষই এক একজন ব্যর্থ সহিস!
হালদার মাতৃমাছ
জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় মাছের খামার,
প্রসবিত ডিমের জন্য কাঁদে মাতৃহৃদয়,
খামারির বিমর্ষ চোখের নুনে হাওয়া দেয় গৃহমন্দা।
মাছ ও মানুষের অশ্রু শেখে একই নামতা।
হালদায় ডিম ছাড়তে আসা রুই, কাতলার বেদনায় ছেয়ে যায়
উর্বরা জলের ভাণ্ডার। ডিম সংগ্রহে আসা জেলেরা শোনে
বাতাসে ছড়িয়ে থাকা আসন্ন প্রসবা মাছের শোকগীত।
জলের নিচ থেকে ওঠা বুদবুদে মাছেরা প্রকাশ করে ভবিষ্যৎ
প্রজন্মের সঙ্গে দেখা না হওয়ার শোক। সংগৃহীত ডিম নিয়ে
যারা ফিরে যাবে তাদের আনন্দের সঙ্গে এর সম্পর্ক নেই।
আহা মাতৃ মাছ, প্রসবিত ডিম থেকে জন্মাবে যে শিশু
তাকে কে শোনাবে ঘুমপাড়ানিয়া গান? শেখাবে জলের সংগ্রাম।
কখনো হবে না দেখা মায়ের মুখ, জানবে না কুল-পরিচয়!
ভূমিকম্প... রিখটার স্কেল ৭.৮
এখানে সেখানে, খসে গেছে পলেস্তারা;
বেরিয়ে পড়েছে ইটের লাল মুখ,
হঠাৎ দুর্ঘটনায় চামড়ার পাহারা পেরিয়ে
যেমন প্রকাশিত হয় রক্তের রূপ।
প্রায়ান্ধকার সেই বাড়ি, দেড়শ’, দুইশ’ কিংবা
এই শহরেরই সমান আয়ু নিয়ে এখনো চলছে পথ,
শতবর্ষী বৃদ্ধার গতিতে। অন্ধকার সিঁড়িতে পথ ভাঙা দায়,
দেখা যায় না শরীর, অমাবস্যায় যেমন বৃক্ষও
দেখে না ডাল-পাতার রঙ।
বহু শরিকের বাড়ির কিছুটা অংশ সংস্কার করা,
মোটা দেয়ালে চুনকামের হাসি। শেষ কবে রেখেছি পা,
সেই স্যাঁতসেঁতে সিঁড়িতে? এক যুগ? সেখানে তখন
থাকেন মা, বাবা, ভাই ও ছায়ানটে গান শেখা কন্যা।
স্কুলপড়–য়া সেই মেয়েটি এখন কত বড়?
মাকে নিয়ে এখনো কি ছায়ানটে যায়?
ভূতাত্ত্বিক প্লেটের প্ররোচনায়, ক্ষেপে ওঠে মাটি,
যদি ভয়ানক ক্রোধে নড়ে ওঠে এ শহর,
বুবলি, আমার ছাত্রী-- বাঁচবে তো?
ঘুমন্ত সন্তানের মুখের দিকে চেয়ে থাকি, অসহায়।
তৃষ্ণা, বালি, প্রতিকৃতি
গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির সঙ্গে
আকাশ থেকে যে স্নেহ
ঝরে পড়ে, তা জলমাত্র নয়
কত পুরনো নদী
জল জল করতে করতে
বালি হয়ে গেল।
জলের হাহাকারে এসব নদীর ক্রন্দন
শিশির হয়ে মিশে যায় বৃষ্টিস্নাত পাতায়।
স্নেহের বাষ্প হয়ে ওড়ে হাওয়ায়।
বালির পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে
মৃতনদীর জানাজায় শরিক হওয়া মাছ,
গাছ, পাখিদের মনে হয় সেই পাথরের কথা।
যার আঘাতে আঘাতে জন্ম বারোটি ঝর্নার।
তাদের আশা-- এভাবে বালিতেও যদি সৃষ্টি হতো ফোয়ারা।
মৃতনদীর প্রতিবেশী পাখি, গাছ, কীটপতঙ্গ, এমনকি মানুষেরাও
তাদের বাকল, ডানা, পালক হাতে আঁকত সেই বালুচরের ম্যাপ।
অশ্রুতে তৃষ্ণা মেটানো পাখির ডানায় লেখা যেত ফোয়ারার ঠিকানা।
একটি একটি করে নুড়ি পাথর ফেলে কলসির তলানির জলে
তৃষ্ণা মেটানো কাকের বংশধররাও হিজরত করত সেখানে।
পাখা পুড়ে যাওয়ার পর
ছুলেই জমে যায় হাত; জমাট বরফের চাই,
তুমি বরং জল হয়ে যাও, স্বাগত জানাও
মাছ ও মানুষের তৃষ্ণাকে।
যেসব প্রজাপতি এখনো ফেরেনি ফুলের মিছিলে তাদের
খোঁজে ভিনগাঁয়ে পৌঁছে দেখি অগণিত ছাইয়ের স্তূপ।
পাশেই উদ্ধারকৃত জাহাজের খোলে পাওয়া
মাছের শব থেকে ছড়ানো আঁশ।
বরফকলের জল যেভাবে গান গাইতে গাইতে জমে যায়,
যেভাবে থেমে যায় জিয়ল মাছ ডিপ ফ্রিজের খোলে,
শীতল সমুদ্রে যেভাবে ডুবে যায় জাহাজডোবা যাত্রী,
মৃতবাড়ি যেভাবে ভরে যায় প্রিয়-অপ্রিয় শুভার্থীর পদধুলায়।
সেভাবেই আহত ভাইয়ের শুশ্রুষা করে শালিকের বোন।
শবের স্বজনেরা শুধু পেছনেই ফিরে যান,
স্মৃতি খুঁড়ে তুলে আনেন সম্পর্কের বাসি আনাজ,
যদিও সেখানে বন্ধন নেই
কোনো প্রজাপতি বা তাদের পাখার।
প্রজাপতি জীবদ্দশাতেই অনুগত থাকে পাখার;
স্বজনেরা মৃত্যুর পরই হয় নিঃশর্ত ও মানবিক।
স্বীকারোক্তি
কিছু পিঁপড়ে প্রায়ই বাঁচিয়ে দেই।
উপদ্রব বেড়ে গেলে, সন্তানের বিছানা, বালিশে তোশকে,
খাটের আনাচে কানাচে আস্তানা গাড়লে, চিরুনি অভিযানে
নিহত পিঁপড়ে, কিংবা ডিপ ফ্রিজের শিং মাছগুলো,
তাদের দাপাদাপির দৃশ্য, জমে যাওয়ার আগে
প্রাণান্তকর বাঁচার চেষ্টা; হানা দেয় মনে॥
অথবা সেই খাসি দুটো, জবাইয়ের মুহূর্তে;
শেষ চিৎকারে জানিয়ে গেছে তীব্র ঘৃণা, রক্তে রাঙিয়ে
হন্তারকের পাঞ্জাবি; তারাও হাজির মাঝরাতে।
পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নিহত পিঁপড়েরাও
স্লোগানে স্লোগানে ভাঙায় ঘুম।
শিং মাছগুলো বসে থাকে প্লেটে, বলে--
স্বীকার কর, ঠাণ্ডা মাথায় হওয়া এসব খুনের ঘটনা।
নিজেকে সেই হাঁসের চেয়ে উত্তম মনে হয় না,
সেই পৃথুলা হাঁস, থকথকে কাদার উঠোনে হাঁটতে গিয়ে,
পায়ের নিচে নিহত পিঁপড়ের জন্য নিজেকে যার খুনি মনে হয়।
ইস্তফা
নিশ্চই আমি পদত্যাগী;
নইলে এই কুয়াশার বাগানে জোনাকি ধরতে আসা!
কথা ছিল পৃথিবীর সবচে’ শীতার্ত দিনে
আকাশের গর্ভে মেঘের জন্ম হলে,
পাতাদের চোখের অশ্রু মুছে দিতে
বহুকালের গুহাবাসী আমি বের হবো প্রকাশ্যে।
সূর্যগ্রহণের মতো সেই মুহূর্তও মহাজাগতিক ঘটনা
হিসেবে আখ্যায়িত হবে আঞ্চলিক অভিধানে।
স্বেচ্ছানির্বাসন না পেরোতেই এই আস্থা!
পাখিরাও এখন আর বন্ধু নয়,
প্রিয় সন্তানের মতো পোষা কুকুরও সরে যায় দূরে।
পিঠের পালক তাই খুলেছি স্বেচ্ছায়।
অবিশ্বস্ত আকাশে ওড়ার কোনো মানে হয়!
তোমরা কি দেখনি,
শত্রুর বুলেটে কিভাবে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে পা?
শোননি, উত্তাল সমুদ্রে কিভাবে লড়েছি হাঙরের সঙ্গে?
একটি ডলফিন শুধু পথ দেখাতে পাশে ছিল সারাটা পথ।
সব বিসর্জনের পর দেখি--
ঝড়ে বিধ্বস্ত একটি কলাগাছ এখনো বাঁচতে ভোলেনি;
আছাড়ে, হাপুরে একটি শিশু নিচ্ছে গতির প্রথম পাঠ।
সহমরণ-ক
এক একটি পাতা খুলে নিয়ে তোমাকে উলঙ্গ করতে চায় যারা,
বন্ধু মানো তাদের!
স্বজন হয়েও তারা একটু একটু করে খুলে নিচ্ছে বাকল বর্ম।
নির্বান্ধব ত্বক থেকে ঝরে পড়া অভিমান, বিষাদ, তোমার স্বপ্ন,
উচ্ছ্বাস, ভেঙে পড়ায় তাদের এসে যায় না কিছুই।
তবু নিজের হাত পা, শরীর, সর্বাঙ্গ পুড়িয়ে তাদের উনুনের
হাঁড়ি জ্বালিয়ে রাখ প্রতিদিন।
সেই উনুনে আমিও পুড়েছি বহুবার,
উত্তরপুরুষেরা চুলার ছাই থেকে একদিন খুঁজে পাবে
হাতের বালা, গলার মাদুলি, প্রিয় নাকফুল।
সহমরণ-খ
ঘাসের সমাধি খুঁড়ে পাওয়া হাজারো ঘাসের কঙ্কালে জমে ওঠা কুয়াশা
সবুজ হয়ে উঠলে অলৌকিক এক নদীর কথা মনে হয়।
জলে জলে খড়কুটোর হাসি, রূপসী মাছের সাঁতার,
সোনালি বাষ্প জলের আবরণ ভেঙে হয়ে ওঠে হাতের কাঁকন,
গলার মাদুলী, ছোট্ট নাকফুল। ঘাসের কঙ্কালের আশেপাশেও
আবিষ্কৃত হয় এ রকম অলংকার।
প্রত্নখননে পাওয়া যায় আরো কিছু তথ্যের হাঁড়িকুড়ি।
যেখানে পাওয়া যায় নারীদের চুলের দলা, হাতখোঁপায় বাঁধা সৌখিন কাঁটা,
এই মাঠেও একদিন জনসমাগম হতো,
সমবেত জনতার উৎসাহী চোখের সামনে
এখানে জ্বলে উঠত সহমরণের চিতা
বর্ষসেরা মেঘের আসর
কাশবনে হারিয়ে যাওয়া বিড়ালের বাদামি চোখ
ডুবে যায় খড়কুটো হয়ে দীর্ঘ জলোচ্ছ্বাসে;
ডুবন্ত বালক তা আঁকড়ে ধরে মার্বেল ভেবে
হাতের মুঠোতে খেলা করে
চোখ ও মার্বেল, মার্বেল ও চোখ।
কাকে যে স্তুতি করো! কাকে যে ঘৃণা!
কার চোখে চাষ করো নিন্দার ধান,
চাতালের নারীরা সেই ধানে সিঁথি কাটে অভ্যস্ত পায়ে।
ফাটা গোড়ালির ফাঁকে বিঁধে থাকা কিছু ধান, ধুলো
সেসব বিবর্ণ পায়ের পরাস্থ প্রজা।
আহা! সম্পর্কের সব ভাঁজ খুলে দেখি
স্বার্থের একমুখী তিল ডুবে যায় গালের টোলে।
প্রত্ন পাথরের ঘুম ভাঙিয়ে একটি শিশু প্রজাপতি
পৃথিবীর সব পাখির কাছে নমস্য হয়,
ডানার ওমে জমা হয় সেই পাথরের শতাব্দী দীর্ঘ ঘুম।
যার ছিটেফোঁটা এসে জমেছে চোখের পাতায়, তাই
আমিও খুইয়ে আসি শাপলার বিলে বিশ্বাসের একমাত্র কয়েন।
চুলের সমাধিতে রেখে আসি কেশ তেলের কৌটা
তোমাদের বর্ষসেরা মেঘেরা বৃষ্টির মোড়কে ফিরে আসে উঠোনে
বলে-- আমরা আকাশের পরিত্যক্ত সন্তান,
ভালোবাসি তৈলাক্ত উঠোনের ক্যানভাস,
ধুলো ওড়া দিনে আকাশের প্রত্যাখ্যানে
যেখানে ঠোঁটের তুলিতে এঁকে ফেলা যায়
যেকোনো জন্মের ছাইরঙা পোর্ট্রেট।
বর্ষসেরা মেঘ, সব কৃষকের জমিই প্রত্যাশা করে জলের।
অথচ বেছে বেছে তুমি বর্ষিত হও সম্পন্ন উঠোনে।
জলমহালের অশ্রুসিক্ত গাঁথা
সহজ মুখের নির্লিপ্ত পাঠ ভুলিয়ে দেয়, ঈর্ষার কাঁটা
থাকে সবার বুকেই। আবিষ্কৃত শিলালিপি জানায়--
লিপিকারদের প্রেয়সীরাও ভালোবাসতেন বর্ণমালার ঘ্রাণ
বসন্তের প্রতি যেমন আনুগত্য কোকিলের
তবু বলি একক আনুগত্য ছেড়ে, পথের ধুলো যত
মাখবে আঙুলে ভ্রমণের দৈর্ঘ্য ছেঁটে ফেলবে স্বজনের তালিকা।
তবু সেই শ্যাওলা প্রজন্ম যারা বেড়ে উঠছে শুনে শুনে শতবর্ষী
কাছিমের গান, নির্লিপ্ত থাকবে চেয়ে। পাড়ের কড়ই গাছেরাও
বিস্ময়ে দেখবে জলে পড়া ছায়া। সে ছায়ার নিচে থাকা
মাতৃ মাছেরা, জলের নামতা পড়তে পড়তে শিশুদের
শোনাবে ঘুম পাড়ানিয়া গান। মেলে ধরবে জলজ রূপকথা।
কেউবা ফিরে যাবেন পূর্বপুরুষের ফেলে যাওয়া
গল্পের ঝাঁপিতে। গল্প নয় সত্যি। মুক্তিসেনার লাশ পানিতে
পচে গলে কীভাবে ছড়িয়েছিল দুর্গন্ধ! হাত-পা বাঁধা সেইসব
মৃতদেহ দেখে অঝোরে কেঁদেছিল মৎস্য নারীরা,
এমনকি কঠিনপ্রাণ কইয়েরাও। তাদের অশ্রু দিঘির জলে মিশে
সেবার বর্ষার অনেক আগেই ডিঙিয়েছিল পাড়ের সীমানা।
নগর...ডোবা...জল
কাছেপিঠে যত নদী-- দূষিত জলের কান্না;
কাছেপিঠে যত গাছ-- ঝরাপাতার উৎসব
শেষে ইটভাটায় মরেছে ডুবে।
এই জনপদে যেদিন প্রথম রেখেছি পা
সেদিনই বরাদ্দ হয়ে গেছে দূষিত সিসা।
মৃত্যুর আগে প্রতিবেশী ডোবাপুকুরটি ফুপিয়ে কেঁদেছে প্রতি রাতে।
সে কান্নাকে গোপনে পাহারা দিয়েছে অধীনস্থ বুকের কচুরি ফুল।
যেভাবে কাকতাড়–য়া থাকে ফসলের পাহারায়,
ক্লান্ত মা যেভাবে পাহারা দেন সন্তানের অসুখ...
ঘোর বর্ষণেও যে বৃদ্ধ পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম গো
সদস্যের জন্য কচুরিপানা কাটতে আসত, সেও শোনে
নির্মাণাধীন ফ্ল্যাটের নিচ থেকে ভেসে আসা জলের হাহাকার।
যে মাছ বিক্রেতা পাশের ডোবা থেকে
ধুয়ে নিত বেলাশেষের শূন্য হাঁড়ি, মলিন হাত-পা,
সেও বিস্ময়ে দেখে নতুন গড়ে ওঠা বাড়ি।
বৃষ্টি নামলেই যে বালকেরা পাশের জমিটুকুতে মেতে উঠত ফুটবলে,
সদ্য তৈরি টিনশেডের কোনো কিশোর হয়তো তাদেরই সহপাঠী।
বহু বছর পর সন্তানকে যদি এখানে নিয়ে এসে বলি--
এই যে বহুতল ফ্ল্যাট, একদার সে পুকুর,
তার পাড়ে গজিয়ে ওঠা কচুশাক থেকে
সে পেয়েছে মাতৃগর্ভের ক্যালসিয়াম, আয়রন।
এখানেই সে শুনেছে ত্রিশুলের ফলায় গেঁথে থাকা পাখির ক্রন্দন।
কাদাজলে ঠোঁট ডুবিয়ে খাবারের সন্ধানে
ডুবসাঁতারে মেতে ওঠা হাঁসের ডাকাডাকি,
তার বিস্মিত চোখে হয়তো ভেসে উঠবে
বেগুনি কচুরিফুল, টলটল জলের সরোবরে,
ভেসে ওঠা তিতপুঁটির ঝাঁক।
হন্তারক
মাঘের জঙ্গলে আগেভাগে গিয়ে
যারা বাঘের কবলে পড়েছে
আমি তাদেরই দলে।
গোলপাতা, মধু বা কাঠের প্রয়োজনে,
আযৌবন এসেছি এখানে।
বাঘের পদচিহ্ন খুঁজে খুঁজে ভেঙেছি পথ।
আমার কন্যাদের বলো-- তাদের ব্যর্থ পিতা, গোলপাতার ভাই,
জোনাকিপোকার সহপাঠী, কাঠের বিকল্প কাঠ,
যার পিঠে পেরেক ঠুকেছে মহাজনের ঋণ।
কুয়াশায় ভেসে বেড়ায় যেসব জোনাকি
আমার ভিটেতে তারা তালগাছ হয়ে জন্ম নেবে।
নদী সাঁতরে যে বুড়ো বাঘটি গ্রামে ঢুকেছে,
ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, সেই হন্তারক আমার!
দেড় যুগ বয়সী জীবনের সেই ছিল শেষ দিন।
স্ত্রীর চোখের অশ্রু মাটিতে পড়েই শুকিয়ে গেল।
বাঘের পেট চিরে দেখ, ভেতরে দিব্যি বেঁচে
সেই চিরচেনা আমি।
পুত্রের হত্যাকারীর পিঠের চামড়ায় বসে বৈঠক চলছে,
অথচ পুনর্বার নির্বাচিত হচ্ছে পিতার খুনি...
কিভাবে পেয়েছ ক্ষমা নিজের কাছে?
অতিথি
চেনা যায়? জলবাহকের ঘটি থেকে চুইয়ে পড়া জল
তৃষ্ণার্ত ধুলোয় গেছে মিশে
মায়ের চোখ থেকে ঝরা অশ্রু, সন্তানের
আহত বাক্য যাকে ডেকে এনেছে গালে
মাছের শেষ নিঃশ্বাসের সাক্ষী সেই দা
বিভাজিত করেছে জিয়ল মাছের শরীর
সবজির ভেতর বেড়াতে আসা এক পোকা,
নিঃসংকোচে কেটেছে অন্তর্গত সিঁদ
অনুতপ্ত মায়ের বুকে চেপে বসা এক ভারী পাথর
বারবার হত্যা করেছে সন্তানের ভ্রুণ।
আলমিরা থেকে খোয়া যাওয়া গ্রন্থ,
প্রাপকের কাছে এখনো হয়নি ফেরা।
হাসপাতালের চুরি হওয়া শিশু,
বেড়ে উঠছে ভুল মায়ের সাহচর্যে
এরা সবাই নিমন্ত্রিত আজ, ঘাসের কুলখানিতে।
মায়ের অনুতাপের অশ্রু যখন পোরোলে চিবুকের সীমানা,
সাক্ষী থাকে ফুলতোলা বালিশে ক্রন্দনের চিহ্ন আঁকা জল,
ইটের নিচে চাপা পড়া হলুদ ঘাসের শেকড়ে বাসা বাঁধা
পোকার সংসারেও বসে থাকেন এক উদভ্রান্ত মা,
সবজিবাসী সেই পোকার মতো।
কৃষকেরা যাকে তাজা কীটনাশকসহ তুলে নিয়ে যায় হাটে।
ক্রোধের বঁটিতে কেটে, বিশুদ্ধ অশ্রুতে ধুয়ে, অনুতাপের আগুনে
কী রাঁধা হচ্ছে? কীটনাশকের ব্যঞ্জন? নকি পোকার ঝালফ্রাই!
অনুতাপের কিছু রেখা যতই মুছে দেয়া যাক
ক্রমেই তা আরো স্পষ্ট হয়ে ওঠে
স্বপ্ন
শুধু স্বপ্ন দেখার অপরাধে ফাঁসি হয়ে গেল!
তবুও সান্ত্বনা-- ঘোর অমাবস্যায়
বয়ামে বয়ামে জ্যোৎস্না পোষা।
অন্ধকার জীবনে এক একটি বয়াম লণ্ঠনের মতো জ্বলে।
স্বপ্ন ছিল-- এই জ্যোৎস্নায় কেটে যাবে
মরু অঞ্চলের মতো দীর্ঘ এক একটি রাত।
শ্বেত ভালুকেরা তুষার ঝড়েও যেভাবে হেঁটে যায়,
সেভাবে পাড়ি দেয়া এক একটি বিষণ্ন দিন।
এ তল্লাটে স্বপ্ন দেখলেও ফাঁসিতে ঝুলতে হয়।
আশেপাশে খুঁজে পাবে আরো কতশত কঙ্কাল
স্বপ্ন দেখেনি বলে যাদের হত্যা করা হয়েছে।
তবু হায় মৃত্যুকে কুর্নিশ করতে নেই।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment