Saturday, August 28, 2010

কিছু লিংক

১।
মানবাধিকার-বিরোধী ফ্যাসিবাদী শক্তিকে রুখে দিতে হবে
: ফরহাদ মজহার
http://www.chintaa.com/index.php/chinta/showArchive2/43/bangla

২। আমাদের কী আর বলার থাকতে পারে! : ফরহাদ মজহার
http://www.chintaa.com/index.php/chinta/showArchive2/67/bangla

৩। দিল্লির সাথে শেখ হাসিনার চুক্তি আত্মঘাতী বশ্যতা : ফরহাদ মজহার
http://www.chintaa.com/index.php/chinta/showArchive2/68/bangla

৪। চিন্তা
http://www.chintaa.com/index.php/chinta/index/bangla

৫। হাইব্রিড ধান বিষয়ে কাজী মামুন
http://www.facebook.com/porimanob#!/note.php?note_id=379940338284

৬। সোনার বাংলাদেশ ব্লগ
http://www.sonarbangladesh.com/article.php?ID=1793

৭। হুমায়ূন আজাদ কর্তৃক অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক --
http://www.sendspace.com/file/s9dguy

৮। সুনৃত সম্পাদকীয়-

http://www.sendspace.com/file/n6i2wh


ঐ পিডিএফ
--
http://www.sendspace.com/file/20jqiz

৯। ভাবান্দোলন--
http://www.sendspace.com/file/u0kedq

Thursday, August 19, 2010

কিশোরী শাহীন, কাশফুল এবং নূরেমবার্গ ট্রায়ালের রেকর্ডভুক্ত নারীর ছবি



মেয়েটি কাশফুল ভালবাসত। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে ফুটত কাশফুল। একদিন বলল আঙ্কল, আমাকে নিয়ে যান। আমি দুর্গা দিদি হতে চাই। শাদা কাশফুল হতে চাই।
এখানে সম্ভব অপু-দুর্গা হওয়া। একটু অপেক্ষা করলেই অপর পার থেকে ট্রেন আসে। কু-উ-উ শব্দ করে। নদীর উপর দিয়ে শ্যামগঞ্জ থেকে হাওয়া মেখে আসে এই ট্রেনটি। আসে পূর্বধলার লোকজন।

শাহীন একদিন পূর্বধলা যেতে চেয়েছিল।

এইসব ১৯৭১ সালের আগের কথা। শাহীনদের বাসাটি ছিল পুকুর পাড়ের পশ্চিপ্রান্তে। ওর আব্বু কাজ করতেন ময়মনসিংহে-- কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক আব্দুর রহিম। পাক আর্মি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলে ঘাঁটি গাড়ে। অনেক লোকজনকে ধরে এনে ছাত্রদের কক্ষের মধ্যে পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে। আমি ১৯৮৪ সালেও দেখেছি আওয়ালের রুমের ফ্লোরে পোড়া মানুষের দাগ। এখনো আছে। আমি এই রুমের মধ্যে কখনো ঘুমোতে পারিনি।

বধ্যভূমিতে শহীদের করোটিতে শ্বেতদ্রোণ ফুল : কেওয়াটখালির কাছে কৃষি বিশ্বদ্যালয়ের অতিথি ভবনের পাশে। আলোকচিত্র : নাইবউদ্দিন আহমদ।
নাইব চাচা--আলোকচিত্রশিল্পী নাইব উদ্দিন আহমদের সম্বল মাত্র একটি রোলিফ্লেক্স ক্যামেরা। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বাঙালিদের ধরে এনে ব্রাশ করে পাকবাহিনীরা মেরে ফেলেছে। নদীর জল হয়েছে লাল। ভেসে গেছে জলের সঙ্গে।
কাশবনের ভিতর থেকে নাইব চাচা দেখেছেন পাশেই গড়ে উঠেছে বধ্যভূমি। এইখানে দিনে রাতে শিয়াল কামড়ে টানাটানি করে সদ্য গুলি করে মারা লাশ। কোনো কোনোটি গলে পচে গেছে। কোনো কোনোটির কেবল করোটি আছে। তার মধ্য দিয়ে শ্বেতদ্রোণ ফুল ফুটেছে। আর উড়ে আসছে শকুন।

একদিন খবর পেলেন শাহীন হাসপাতালে। বাইরে শাহীনের আব্বু মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছেন। একবারে ভেঙে পড়া। তাকিয়ে দেখার শক্তি নেই। ভিতরে শাহানা চিৎকার করে কাঁদছে। মাথার চুলগুলো এলামেলো। আম্মু শাহানাকে ধরে রাখতে পারছেন না। বলছে- আম্মু ওরা আমাকে মেরে ফেলেছে। আমাকে বাঁচাও।

শাহীন তখনো বেঁচেছিল। মরতে মরতে বেঁচেছিল। নরপশু পাকআর্মিরা আত্ম সমর্পন করার পরে তাকে একটি কক্ষ থেকে বের করে আনা হয়েছে। হাঁটতে পারেনা। মুখের চামড়া উঠে গেছে। খুবলে খুবলে খেয়েছে গায়ের মাংস। বলেছে- তোর পেটে সাচ্চা পাকিস্তানী আদমী পয়দা দিয়েছি।
নাইব চাচার পায়ের শব্দ চিনতে পেরেছিল শাহীন। আহা, আমাদের হৃদয়ের বোন এই কিশোরী মেয়েটি। কাশফুল ভালবাসত। কাশফুলের ভিতরে যেতে চেয়েছিল চাচার সঙ্গে। হতে চেয়েছিল ছবি।

গ্রামটির নাম নিলক্ষ্যা। এখানেই পাক আর্মি চলে যাওয়ার পরে এই ছবিটি তুলেছিলেন নাইব চাচা।
চাচাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠেছিল- ওরা আমাকে মেরে ফেলেছে। আমাকে বাঁচান।

শাহীন নামের সেই মেয়েটি বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু মুখ ঢেকে রেখেছিল চুল আর হাতের আড়ালে। মুখ দেখাবার জন্য কিছু তো রাখেনি পাক হানাদার নরপশুরা। তাকে বাসার সামনে থেকে জামাতী নরপশুরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তুলে দিয়েছিল সোহরাওয়ার্দী হলে। পাকিস্তানী হায়নাদের কাছে। কিশোরী মেয়েটির আর কাশবনে যাওয়া হয়নি।

শাহীন এর পরই সত্যি সত্যি মরে গিয়েছিল। কাশবনের পাশে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে। কিন্তু শাহীন রয়ে গেছে নাইব চাচার রোলেক্স ক্যামেরায়। আজও - উনচল্লিশ বছর পরেও। আর তার হাহাকার। নাইব চাচার চোখ ভরে এসেছে জলে। শাহীনের ছবিটি দেখাতে দেখাতে বলেছিলেন-- খোকন, আমার মনের ক্যামেরায় এরচেয়ে অনেক অনেক ভয়ংকর ছবি তোলা আছে। আমি চোখ বুঝলেই দেখতে পাই। সেই সব চোখ ভর্তি ছবি নিয়ে গত ডিসেম্বরে চিরকালের জন্য নাইব চাচার চোখ স্বব্ধ হয়ে গেছে। তিনিও এখন কাশফুল।

ডালাস থেকে মাহাবুব জালাল ভাই একটি ছবি আমাকে পাঠিয়েছেন। বললেন, দেখো। পোলান্ডে হিটলারী বাহিনীরা শাহীনদের মতো মেয়েদের নগ্ন করে হাঁটিয়ে নিচ্ছে কনসেন্ট্রশন ক্যাম্পে। হিটলার বাহিনীকে কিন্তু ছেড়ে দেওয়া হয়নি। তাদের বিচার হয়েছে। বিচার হচ্ছে আজও তাদের সহযোগীদের।


তিনি মুজিব মেহদী আর রোকেয়া কবীরের মুক্তিযুদ্ধ ও নারী গ্রন্থ থেকে একটি পৃষ্ঠা আমাকে পাঠিয়েছেন। লেখা...'মেয়েদের ধরে আনা হলে কে কোথায় যাবে এবং তালিকা অনুয়ায়ী নির্ধারিত অফিসারের কাছে নির্দিষ্ট মেয়েকে পাঠানো হতো। বন্দি হারেস উদ্দিন ১২ নম্বর ব্যারাকের ১০ নম্বর কামরায়ও ৫০ জন নারীকে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি জানান, বন্দি মেয়েদেরকে তিনভাগ করা হতো। প্রথম ভাগে থাকত যুবতী, দ্বিতীয় ভাগে মধ্যবয়সী এবং তৃতীয় ভাগে সন্তানের মাতা। তিনি জানান, স্কুল-কলেজের অল্পবয়েসী কিশোরীদের বিমানে করে ঢাকায়ও পাঠানো হতো। আরেকটি ঘটনায় জানা যায়, ভারতগামী একদল শরণার্থীর সবাইকে হত্যা করে তাঁদের মধ্য থেকে ১৫ জন কিশোরী-যুবতীকে পরণের কাপড় খুলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় কয়েক মাইল হাঁটিয়ে মহেশপুরে নিয়ে আসা হয়। যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত এসব মেয়েদের ভোগ করবার জন্য আটকে রাখা হয়।

কুষ্টিয়ার পাক-ছাউনিতে অজস্র গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে সেখান থেকে একাধিকবার গৃহবধু থেকে শুরু করে অল্পবয়সী সকল মেয়েকে ধরে নিয়ে আসা হয় এবং নয়মাসব্যাপী যথেচ্ছ ভোগ করা হয়। স্বাধীনতার পর এখানকার কেউ কেউ জীবিত অবস্থায় ছাড়া পান।'

শাহীনদের যারা ধরে নিয়েছিল, নির্যাতন করেছিল করেছিল, মেরে ফেলেছিল--তাদেরকে কি ছেড়ে দেওয়া যায়? দেওয়া কি উচিৎ?

এই প্রশ্নটি রেখেছেন জালাল ভাই। তিনি আরেকটি কথা বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের দলিলের অষ্টম খণ্ডে বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র প্রকাশ করেছে। সেগুলো এখন রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। কিন্তু বাংলাদেশে দৃকে'র ডঃ শহীদুল আলম আলোকচিত্রশিল্পীদের কাছ থেকে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সেইসব ছবির স্বত্ত্ব টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছেন। দৃকের মাধ্যমে তিনি অগাধ ধনসম্পদের মালিক। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সম্পদ এই ছবিগুলি তিনি কিভাবে কেনার সুযোগ নিলেন? বিশ্বযুদ্ধের ছবিগুলো কিন্তু কেউ কেনার সাহস করে নি। বাণিজ্য করার কোসেস করেনি। ওগুলো পৃথিবীবাসীর সম্পদ। ডঃ শহীদুল আলম ফরহাদ মজহার ঘরাণার লোক। ফরহাদ মজহারতো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ফ্যাসিবাদি কর্ম বলেই মনে করেন। যুদ্ধপারাধিদের পক্ষে কলম ধরেন। তাঁর সুহৃদ ডঃ শহীদুল আলমের এই মুক্তিযুদ্ধের দলিল ছবিগুলো কিনে নেওয়ার মাজেজাটা কি?

পশ্চিম বঙ্গের কবি গৌতম চৌধুরী বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক মৌলবাদিদের সার্টিফিকেট কেন দিচ্ছেন? বিষয়টা কি??

গৌতম চৌধুরী কবি। তার বাড়ি পশ্চিবঙ্গে। তিনি আমাকে মেইল করেছেন। বলেছেন- রাও ফরমান আলী খান : ঠাণ্ডা মাথার খুনি নোটের একজায়গায় লিখেছেন - "কিভাবে দৈনিক নয়া দিগন্তে ফরহাদ মজহার নামক লোকজন লেখেন- আবহমান বাঙালি চেতনা একটি ফ্যাসীবাদি চেতনা। " - দয়া ক'রে যদি ফ.ম-র ওই লেখাটি পড়ান, কৃতজ্ঞ রইব।

আমি একাত্তরের গণহত্যার কাপালিক রাও ফরমান আলি খানকে নিয়ে একটি নোট লিখেছিলাম। রাও ফরমান আলিরা শুধু ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যা করেনি- তারা হাজার বছরের আবহমান বাঙালি জাতিকে ও চেতনাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। এখনো তা শেষ হয়নি। নানাভাবে রাও ফরমান আলির চেলা চামুণ্ডারা এই কাজটি এখনো করে যাচ্ছে। ফরহাদ মজহার নামের কতিপয় জীবিত ভাঁড় এই কার্যক্রমকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কবি গৌতম চৌধুরী এটা বিশ্বাস করেননি। মনে করেছেন- আমি বোধহয় বানিয়ে বানিয়ে ‘অকথা-কুকথা’ বলেছি ফরহাদ মজহার সম্বন্ধে। তিনি বারবার আমাকে মেইল করে ফরহাদ মজহারের ওই লেখাটি চাচ্ছিলেন। আমার অত সময় নেই সবার অনুরোধ রক্ষা করার। কিন্তু গৌতম চৌধুরীর বারংবার অনুরোধে আমি লেখাটির লিংক পাঠালাম। এ সংক্রান্ত নানাজনের মন্তব্যের আরেকটি লিংকও তাকে দিলাম। তিনি সেটা পড়ে লিখলেন- ‘ফরহাদ মজহার হলেন জীবিত বাঙালি শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে একজন। ফরহাদ মজহার হলেন বিভাগোত্তর বাঙালি জাতির একজন শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ। সব বিষয়ে যে তাঁর সাথে সবাইকে সহমত হতে হবে, এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি। তবে তাঁর চিন্তাকাঠামোর মোকাবিলা করতে চাইলে তা তো করতে হবে চিন্তা দিয়েই। আকথা-কুকথা বলে উড়িয়ে দেবার মতো খড়কুটো তিনি নন ।’

ফরহাদ মজহারতো নিজেকে বাঙালি বলে স্বীকারই করেন না। তাকে কেন জীবিত বাঙালি শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে একজন বলছেন গৌতম চৌধুরী? ফরহাদ মজহার বাঙালি জাতীয়তাবাদকে ফ্যাসিবাদি হিসাবে স্পষ্টভাবে নির্দেশ করেছেন। তিনি বলেছেন, 'বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ একনায়কতান্ত্রিক ক্ষমতা পরিগঠনের মধ্যে শুধু নয়, ছিল নৃতাত্ত্বিক বাঙালি জাতীয়তাবাদী ধারণায়, তথাকথিত ‘সমাজতন্ত্রে’ এবং নিরন্তর এক যুদ্ধংদেহি মনোভঙ্গির চর্চায়। ফ্যাসিবাদ মজুদ ছিল আমাদের সেই সকল ধ্যান, ধারণা, আকাংক্ষা ও আবেগের মধ্যে যাকে আমরা কোন দিনই সন্দেহ করি নি, সন্দেহ করতে শিখি নি।' (৭ জুন, ২০০৮, দৈনিক নয়া দিগন্ত)। http://www.dailynayadiganta.com/2009/06/07/fullnews.asp?News_ID=149127&sec=6

তিনি লিখেছেন- ‘মুক্তিযুদ্ধ এখনো আমাদের অধিকাংশের কাছে দুই নৃতাত্ত্বিক সম্প্রদায় ‘বাঙালি’ বনাম ‘পাঞ্জাবি’র লড়াই।’ একাত্তরের পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বীর বাঙালিদের অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করাকে তিনি ধিক্কার দিয়েছেন। বলেছেন- এই অস্ত্র ধারণের কারণে মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। ফরহাদের মতে- যুদ্ধের চেয়ে ‘একটি নির্যাতিত জনগোষ্ঠির প্রতি বে-ইনসাফি এবং নির্যাতিতের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ইত্যাদি রাজনৈতিক প্রশ্নই ছিল মুখ্য’। অস্ত্রের চেয়ে তার মতে ‘নৈতিক শক্তিটাকে বড় করে দেখা দরকার ছিল’। কী মনে হয়- গান্ধী কথা বলছেন!!

প্রশ্ন হল- ফরহাদ মজহার ষাট দশকের সময় থেকে গান্ধিজীর অহিংস পাঠশালায় ভর্তি হননি। গলাকাটা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার নেতা সিরাজ সিকদার একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেও ফরহাদ মজহার তার বিরোধীতা করেন। তখন তিনি কোথায় ছিলেন? কুড়িয়ানার পেয়ারা বাগানে? সেখানে তাকে দেখা যায়নি। দেশ স্বাধীনের পরে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বিপ্লবী হুমায়ূন কবীরের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। তার গুরু আহমদ ছফা তার ডাইরীতে একথা বলে গিয়েছিলেন ষ্পষ্টভাষায়- নূরুল আনোয়ারের সম্পাদনায় ২০০৪ সালে আহমদ ছফার ডায়েরি নামে একটা বইতে ছফা সাহেব লিখেছেন--
"ভাত খেলাম। কাপড় ধুয়ে দিলাম। ঘুমোলাম। মনওয়ার এবং মসি এসে জাগালো। মসি ছেলেটাকে আমি ভয়ঙ্কর অপছন্দ করি। মনে হয় ছেলেটা কি একটা মতলবে ঘুরছে। আমার ধারণা হুমায়ুনের মৃত্যুরহস্যটা সে জানে। দিনে দিনে এ ধারণাটা আমার মনে পরিষ্কার রূপ লাভ করছে। কেমন জানি মনে হয়, ছেলেটার হাতে রক্তের দাগ লেগে আছে। এ ধরনের ছেলেদের কি করে এড়িয়ে চলবো সেটা একটা সমস্যা। রেবুদের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করতে হবে সম্ভবত। এখনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত করতে পারিনি। আশা করছি এরই মধ্যে নতুন কোনো তথ্য জেনে যাবো। ফরহাদ মজহারের আমেরিকা পলায়ন, সালেহার সঙ্গে স্বামীর পুনর্মিলন এসবের সঙ্গে বোধ হয় হুমায়ুনের মৃত্যুর একটা সম্পর্ক জড়িত রয়েছে। লিংক- "http://www.facebook.com/note.php?note_id=94343956157&ref=mf
আহমদ ছফা আঁতকে উঠে এই গুরু মারা শিষ্য সম্পর্কে বলেছেন- ফরহাদ মজহার লোকটা সন্দেহজনক।

আমেরিকা পালিয়েছিলেন আরেক ছদ্মবেশী-সুবিধাবাদি সৈয়দ আলী আহসানের লেজ ধরে। সৈয়দ আলী আহসান সামরিক শাসক ও মৌলাবাদের চোঙ্গা ফুকাতেন। পাকস্তিান আমলে রবীন্দ্রবিরোধীতার পুরোধাঁ ছিলেন।

একাত্তরের পরাজিত শত্রু –ঘাতক জামায়াতে ইসলামী কিন্তু ফরহাদের এই কথাটাই বলে যে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ ছিল ভুল। ওটা ছিল ছিল ভায়ে ভায়ে দ্বন্দ্ব। ফরহাদ মজহার জামাতের কথাটা একটু আধুনিক ভাষায় কয়েছেন মাত্র। জামায়াত বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের শ্রষ্টা ও মদদদাতা। এই জঙ্গীরা যখন সারা দেশে বোমাবাজি করেছে- তখন জামায়াতের আমীর বললেন- এই বোমাবাজি আসলে র এবং মোশাদের কাজকারবার। তাকে যখন প্রশ্ন করা হল- এ তথ্য কোথায় পেয়েছেন ? তখন নিজামী সাহেব বলে দিলেন কমরেড ফরহাদ মজহার এটা লিখেছেন। জামায়াতের তথ্য প্রণেতা হলেন ফরহাদ মজহার! জঙ্গিদের কর্মকাণ্ডকে তিনি ‘সন্ত্রাসী’ বলতে নারাজ। সে সময় জঙ্গীরা বিচাররকদের বোমা মেরে হত্যা করেছে। আর ফরহাদ মজহার এই হত্যাকারীদের সাফাই গেয়ে লিখেছেন- ‘নিজেদের জীবন ও জীবিকা রক্ষা করবার যে কোন লড়াই-সংগ্রামকে এখন অনায়াসেই ‘সন্ত্রাসী’ কর্মকাণ্ড হিশাবে আখ্যায়িত করা সহজ। আমরা তো চোখের সামনেই দেখছি আদালত মানুষের মানবাধিকার রক্ষা করছে না।’

বিগত নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সারা দেশে প্রবল জনমত গড়ে ওঠে। সে সময় ফরহাদ মজহার ছিলেন বিএনপি-জামায়াত জোটের নির্বাচনী প্রচারের কর্মকর্তা। জঙ্গীবাদি সংগঠন হিজবুত তাহরীর একজন নেতা হলেন এই ‘সর্ব শ্রেষ্ঠ জীবিত বাঙালি কবি ফরহাদ মজহার। হিজবুৎ তাহরী এখন বাংলাদেশে একটি নিষিদ্ধ সংগঠন। জামায়াতের পত্রিকা দৈনিক নয়া দিগন্তের নিয়নিত লেখক হলেন ফরহাদ মজহার।

আর চিন্তাবিদ? রবীন্দ্রনাথকে অতিশয় হিন্দু এবং জমিদার বলে গালিগালাজ দিয়ে নিজেই রবীন্দ্র মজহার হতে গিয়ে ফেইল। কেউ তাকে পোছে না। তাই রেগে মেগে হতাশ হয়ে বললেন, নাহ, রবীন্দ্রনাথকে এড়ানো গেল না। তারপর তিনি লালন শাহকে রবীন্দ্রনাথের বিপরীতে দাঁড় করানোর চেষ্টা করলেন। করে নিজেই জীবিত সুফি উপাধি ধারণ করলেন। আর তার দল হিজবুত তাহরির যখন লালন ভাস্কর্য ভাঙতে লেগে গেল তখন এই সুফি চিন্তাবিদ টু শব্দটি করলেন না। বললেন, লালন ছিলেন কুতার্কিক। এই হল চিন্তার শ্রেষ্ঠ চিন্তার নমুণা।

ফরহাদ মজহারকে নিয়ে যত কম কথা বলা যায় ততই মঙ্গল। তার রয়েছে মৌলবাদিদের টাকা, জামায়াত-বিএনপির পৃষ্ঠপোষকতা, এনজিওর নামে মেরে দেওয়া বিদেশী অর্থ, বিপুল ব্যবসা বানিজ্য এবং গাড়ি-বাড়ি-নারী…। এবং কতিপয় ভাড়াতে পেশীবাজি মাস্তান-লেখক। এবং আন্তর্জাতিক কানেকশন। অধুনা পশ্চিম বঙ্গেও এরকম একটি কানেকশন তিনি দাঁড় করিয়েছেন বলে শোনা যায়।

ফরহাদের দায়িত্ব হল- তরুণ বুদ্ধিজীবীদের মগজ ধোলাই করা। তাদেরকে বলা যে-‘রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে হত্যা, চিন্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা রুদ্ধ করা, একদলীয় শাসন কায়েম ইত্যাদি নানান রাজনৈতিক নির্যাতন ও নিবর্তনমূলক শাসনের কারণে বাকশালী আমল ফ্যাসিবাদী আমল বলে গণ্য হয়।‘ বাকশাল বলতে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকেও নির্দেশ করেন। বাকশাল বলাটা তার বাককৌশল। তার ভয়াবহতম প্রকল্প হল- বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানী ধারণায় সাম্প্রদায়িকীকরণ। জনাব ব্রাত্য রাইসু এন্ড গং প্রত্যক্ষভাবে এই দায়িত্ব পালন করছেন। ফরহাদ তরুণ প্রজন্মকে জামায়াতের প্রতি সহানুবূতিশীল করেগড়ে তুলতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এখান দেখা যাচ্ছে- তরুণ প্রজন্ম তাকে বুড়োর আঙুল দেখিয়ে দিয়েছে। জনগণ তার আদর্শের দল জামায়াত-বিএনপি'কে বিদায় করে দিয়েছে।

তাহলে পশ্চিম বঙ্গের কবি গৌতম চৌধুরী এইসব না জেনেই বলে ফেললেন- ‘ফরহাদ মজহার হলেন জীবিত বাঙালি শ্রেষ্ঠ কবিদের মধ্যে একজন। ফরহাদ মজহার হলেন বিভাগোত্তর বাঙালি জাতির একজন শ্রেষ্ঠ চিন্তাবিদ’। বিষয়টা কি?
এক বন্ধু শুনে বললেন- ফরহাদ মজহার কবি! তাঁর কবিতা কে পড়ে এই বাংলাদেশে? তার কবিতা কি শ্রেষ্ঠ মানের কবিতা এবং জনপ্রিয় কবিতা? উত্তর শুনে পুরান ঢাকার ঘোড়াও হেসে উঠবে।

এখন গৌতম চৌধুরী এই একাত্তরের খুনীদের মুখোশ ফরহাদ মজহারকে শ্রেষ্ঠত্বের সার্টিফিকেট কেন দিলেন? পারলে ফরহাদ মজহারতো তার ঈমানী বাহিনী নিয়ে পশ্চিম বঙ্গের দাদাদের বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। আর তার পক্ষে গৌতম চৌধুরী! ফেসবুকে দেখেছি- গৌতম চৌধুরী পশ্চিম বঙ্গের এক কবির কবিতার পোস্ট দিয়েছেন। এর আগে তার নাম শুনিনি। না শোনাটা আমার অন্যায় নয়। পাঠক হিসাবে আমি দুর্বল। কিছুদিন আগে কবি রণজিৎ দাশ ফরহাদ মজহারের অন্যতম স্বজন সাজ্জাদ শরীফের সঙ্গে ফরহাদীয় শ্রেষ্ঠ কবিতা সংকলন করেছেন। কবি জয়দেব বসু জানুয়ারি মাসে সগৌতম চৌধুরী বাংলাদেশ ভ্রমণ করেছেন। তাদেরকে বাংলাদেশে নিয়ে গিয়েছিলেন অগ্রবীজের অন্যতম সম্পাদক মার্কিন মুলুকের সৌম্য দাশগুপ্ত। ভিডিওতে দেখেছি কবি ফরিদ কবিরের সঙ্গে আছেন গৌতম চৌধুরী। ফরিদ কবির সাজ্জাদ শরীফের আপন ভাই। ফরহাদ মজহারের লোকজনের সঙ্গে বাংলাদেশে তারা ফরহাদীয় নানা কিসিমের আয়োজনে ছিলেন। থাকুন- এটা নিয়ে কারো মাথা ব্যথা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু যখন এরা ছদ্ম বুদ্ধিজীবী মৌলবাদিদের সার্টিফিকেট দেন- তখন কিন্তু মাথা ব্যথা হয়। মাথার ভিতরে সেই পুরানো পাখি বলে ওঠে- এরা ভাড়াটে। এদের অনেকেই পশ্চিম বঙ্গে আছেন অভাবে-স্বভাবে। বাংলাদেশের কেউ ইশারা করলেই নাচতে নাচতে তারা এসে পড়ছেন। বাহ্যজ্ঞান শুন্য দশায় যা বলতে বলছে তাদের ভাড়াকারী বুদ্ধিবৃত্তিক মৌলবাদিচক্র- তারা তা অবলীলায় হড়বড় করে উগরে দিচ্ছেন।

কী বলেন পশ্চিম বঙ্গের কবি গৌতম চৌধুরী?

কোথাও মায়া লাগিয়া রহিয়াছে

লিখে লাভ কি?
এই প্রশ্নটি মাঝে মাঝে ভাবি। ভাবি, লেখাটি না হলে কী ক্ষতি হত!

আমি একটি গাছের নিচে দাঁড়াই। গাছটির পাতা নাই। গান নাই। বাকলগুলো তীব্র শীতে ফেটে গেছে। ফাঁকে ফোঁকরে তুষার জমে আছে। গাছটিকে প্রশ্ন করি, ও গাছ- গাছ হয়ে তোমার লাভ কি?
গাছটি কিছু বলে না। একটি কাঠবিড়ালি সুড় সুড় করে বাকল বেয়ে উপরে উঠে যায়। আবার নেমে আসে। পিটপিট করে তাকায়। গাছের ফোঁকরে ঢুকে পড়ে। হারিয়ে যায়। এই ফোঁকরটি না থাকলে কি ক্ষতি হত?

এইসব গুহ্য তত্ত্ব। তত্ত্ব এলে মাথা তপ্ত হয়ে ওঠে। হাসফাঁস করি। সামনের পুকুরটির উপর কে জানি সাদা রং ঢেলে গেছে। রোদ পড়ে চিকচিক করছে। কয়েকটি হাঁস ভেসে বেড়ায় এইখানে । আজ হাঁসগুলি নেই। থৈ থে জলে মাছ ধরতে ভাল লাগে। ঝুঁকে দেখি, কয়েকটি পালক পুকুরে আধখানি ঢুবে আছে। বলছে, আয় না। আয়। একটু একটু করে পা বাড়াই। কাঁপতে কাঁপতে বাম পাটি রাখি জলের উপরে। সাদার উপরে। ভাবি, এইবার ডুবে যাব। ডুবে গেলে কী ক্ষতি? কী লাভ মাটি উপরে দাঁড়িয়ে থেকে! আকাশ দেখা? তারার আলোতে ব্যাকুল হয়ে ওঠা। নেত্রজল মেলে দেওয়া। কোথাও মায়া লাগিয়া রহিয়াছে।

এইসব ভাবলে জলের উপরে হাঁটা যায়। হেঁটে হেঁটে পালকের গায়ে হাত রাখি। কান পাতি। এইখানে কোথাও মাছ ছিল। এখন নেই। মাছ- আমাদের হৃদয়ের মৎসকুমারী বোন- তোমরা এখন কোথায়? হাহাকার করতে করতে আমি জলের উপর দিয়ে ছুটে বেড়াই। ক্লান্ত হয়ে জলের উপর বসে পড়ি। জলকে জলের মত ভেবেছি। পদ্মপাতায় জলদেবী বসে। জল, তুমি জল হলে না কেন?


২.
বহুদিন আগে একটি উপন্যাস পড়েছিলাম। পূর্ণেন্দু পত্রীর। নাম মনে নেই। সেখানে শালতি বেয়ে লোকজন চলাচল করে। জলের উপর ছপ ছপ শব্দ হয়। বহুদিন আমিও শালতি বেয়ে চলে গেছি বহুদূরে। ফিসফিস করে পত্রীকে বলেছি, ওকে ডেকে দাও। মালতীদিদির কাছে যাব। মেয়েটির নাম কি মালতিদিদি? অথবা মাধবী? এইসব মনে নেই। মালতিদিদির শালতির কথা মনে আছে। আর ছোট ছোট ঢেউয়ের মর্মগুলি।

নিশিকুটুম্ব পড়ে মনোজ বসু হয়ে উঠেছিলেন আমার বাড়ির দাদা। এই দাদাটি বলছেন সাহেবের কথা। সারারাত্রি ভর সাহেব ঘুরে বেড়াচ্ছে ঘর থেকে ঘরে। অদ্ভুৎ মেদুর ছোঁয়ায় তার হাতে উঠে আসছে সদ্য বিবাহিত নায়রী মেয়েটির সোনার হারটি, নাকফুল। অথবা কানপাশাটি। ভোরের আলোয় নৌকাটি চলে যাচ্ছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। সাহেব ঘুমিয়ে আছে। শান্ত ঘুম। এই নৌকাটির ছায়া আমাদের চোখের উপরে লেখে আছে। বাতাসের আগে ছুটে চলে। ধরার বাইরে। ছোঁয়ার বাইরে।

ডিঙি নাওটিতে বহুবার উঠেছি। তখনো ভোর হয়নি। ন'মামা বলছে, কেউ ডাকলে সাড়া দিবি না। কে ডাকবে? শুনছি ছোট ছোট শব্দ। কোচের ফলাটির। আর ডিঙির গুরার ফাঁকে জমে উঠছে লবটুলি মাছ।
আমার ডিঙি নাওটি-ই কি কোষা নাও?


৩.
একজন বুড়ো লোক সখ করে কোষা নাওটি বানাচ্ছেন। আর তার নাতিপুতি সুপুরির খোলে চড়ে খেলছে ধুলোর ভিতরে। আর মাঝে মাঝে অধীর হয়ে অপেক্ষা করছে কখন নাওটি জলে ভাসবে। বুড়ো লোকটির কোষা নাওটি পূর্ণ হয়েছে বটে- তবে আলকাতরা লেপার পয়সাটি নেই। গাবের কষ মাখা হল তো জলে ভাসানোর বাতাসা কবে আসবে এই নিয়ে অনেক যত্নের অপেক্ষা আছে। যেদিন বাতাসা এল- আমরা দেখতে পাচ্ছি- কোষাটি জলে ভাসছে। লগি ধরেছেন বুড়ো দাদাজান। আর চড়ে বসেছে কয়েকজন আমরা মানুষ। এরা ভাসতে ভাসতে শাপলা তুলছে। সূর্য ডুবে যাচ্ছে। অন্ধকার ঘিরে আসছে। এ অন্ধকার না এলে কী ক্ষতি হত? তবু অন্ধকার এসেছে। আমরা মানুষের মধ্যে একটি বালককে দেখতে পাচ্ছি- জলের উপরে হাত রেখেছে। রাখতে রাখতে সেও জলের মত শান্ত হয়ে গেছে। খুব শান্ত। এই চন্দন নামের বালকটি আর কখনো ফিরে আসেনি কোষাটিতে। কিন্তু বারবার ফিরে এসেছে আমাদের মনে। দাদাজানের মনে। আর তাই স্তব্দ হয়ে গেল সকলের জলে ভাসা। জলের মত ঘুরে ঘুরে কথা বলা।
আবার একদিন দাদাজান আমাদের ডেকে নিলেন। দেখতে পাচ্ছি তিনি কোষাটিকে ভাসিয়েছেন জলে। আলোর মধ্যে দিয়ে। অন্ধকারের ভিতর দিয়ে। আর ভাসিয়ে দিয়েছেন সেই আমাদের বাইরে চলে যাওয়া চন্দনকে। ছোট ছোট হাহাকারকে। আমরা এই কোষাটির সঙ্গে ভাসতে ভাসতে বুঝতে পারি- কোথাও মায়া লেগে আছে।

৪. শাদামাটা গল্পটি। নিরাভরণ বর্ণনা। কোথাও কোন গল্প জেগে ওঠে না। গল্পের কোন সম্ভাবনাও উঁকি দেখা যায় না। একটি গল্পহীনতার মধ্য দিয়ে আমদের নির্বান্ধব যাত্রা শুরু হয়। কেউ কোথাও নেই। বুঝতে পারি- গল্প ভেঙে দেওয়ার যাদু আমাদের মাথার ভিতরে নীলকণ্ঠ পাখির মত ডাক দিয়ে যাচ্ছে। সাই সাই করে। কোন এক সম্ভাবনার অসীম আকাশে। জল রঙের মত। অস্পষ্ট। রহস্যময়। অপার। প্রাণের মত সৌম্য। নিখিল। তাকে কে এড়াবে এখন?

এই গল্পটি পাপড়ি রহমানের। নাম কোষা। এই না-গল্পের গল্পগুলো নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে এবারের বইমেলায় ধূলিচিত্রিত দৃশ্যাবলি। ধুলি সরিয়ে সরিয়ে এই দৃশ্যাবলি পড়তে পড়তে ভাবি, কী লাভ হত গল্পটি না লিখে? না ভেবে! জলকে জলের মত না ভেবে!


........................
ধূলিচিত্রিত দৃশ্যাবলি
পাপড়ি রহমান
আমার প্রকাশনী

জহির রায়হান : অন্তর্ধান বিষয়ে ১৯৭২ সালের একটি লেখা

সাংবাদিক পার্থ চট্টোপাধ্যায় জহির রায়হানের সঙ্গে দেখা করেন তাঁদের কায়েৎটুলির বাসায়। ১৩ ডিসেম্বর তার অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারকে দুপুরবেলা আল বদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। ১৪ ডিসেম্বর তাকে হত্যা করা হয়। বাড়ির প্রত্যেকের মত জহির রায়হানও এ হত্যাকাণ্ডকে মেনে নিতে পারেননি। তিনি পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে বললেন, আমার বিশ্বাস দাদা এখনো বেঁচে আছেন। বউদিও তাই বিশ্বাস করেন। কিন্তু সম্ভব-অসম্ভব অনেক জায়গায়তো খোঁজাখুঁজি করছি--
-মৃতদেহ কি শনাক্ত করতে পারেননি?
--আন্দাজে শনাক্ত করা হয়েছে। ডেডবডিগুলো এমন বিকৃত হয়ে আছে যে কিছু বোঝা মুশকিল। তাই এখনো সকলের মনে ক্ষীণ আশা তিনি বেঁচে আছেন।
--কারা কারা এই ঘটনায় জড়িত কিছু ধরতে পারলেন?
--একজনকে পাওয়া গিয়েছে। সে স্বীকার করেছে যে সে কালপ্রিটদের চেনে। নামও বলেছে। কিন্তু তাদের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।

... এর কয়েকদিন পরে জহির রায়হান একটি ফোন পান। তাঁকে জানানো হয়, তাঁর দাদা শহীদুল্লাহ কায়সারকে মীরপুরে আটকে রাখা হয়েছে। তিনি মীরপুরে চলে যান। এরপর জহীর রায়হানকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেদিন ছিল ৩০ জানুয়ারি, ১৯৭২।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, জহির রায়হান প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যে সাম্প্রদায়িক চক্র ঢাকার বুদ্ধিজীবী হত্যার পিছনে দায়ী তাদের তিনি নির্মূল করবেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ঢাকায় বুদ্ধিজীবী নিধন অনুসন্ধান কমিটি স্থাপন করেন। কমিটির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন, 'হলিডে' কাগজের সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান।
এই বুদ্ধিজীবী অনুসন্ধান কমিটির অফিস হয়েছিল ঢাকা প্রেসক্লাবে।

জহির একদিন আমাকে বলেছিলেন, প্রেস ক্লাবে আসুন। বহু চাঞ্চল্যকর তথ্য উদ্ধার করেছি। আপনাকে দেখাব।
আমি বলেছিলাম, এখন কি আর কাউকে খুজে পাবেন? এসব পণ্ডশ্রম হচ্ছে আপনার। আর তা ছাড়া স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে। আর তারা কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। যা মারা গেছে তাকে কেন আবার খুঁচিয়ে তুলবেন।
জহির বলেছিলেন, এখানে আপনার সঙ্গে আমি একমত নই। যারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী তারা সাময়িকভাবে গা ঢাকা দিয়েছে বটে, কিন্তু তারা বাইরে কোথাও যায়নি। এই দেশেই আছে। আবার ঐক্যবদ্ধ হতে চেষ্টা করছে। আপনি ভাববেন না, সাম্প্রদায়িক শক্তি চিরদিনে মতো খতম হয়ে গিয়েছে।
জহির বলেছিলেন, আপনাকে আমি ওদের গোপন লিফলেট দেখাব। তাতে ওরা লিখেছে, আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়নি--সবে শুরু। আপনি প্রেসক্লাবে আসবেন, বহু দলিল দেখাব।
নামধাম ঠিকানা সব পেয়েছি--তাদের কিছুতেই নিষ্কৃতি দেওয়া হবে না--আই স্যাল ফাইট আনটু দি লাস্ট।


প্রেসক্লাবে গিয়েছিলাম নির্ধারিত সময়ে। কিন্তু যথারীতি জহির সেদিনও কথা রাখেননি। আলাপ হল এনায়েতুল্লাহর সঙ্গে। আমাকে বললেন, কাগজপত্র সবতো জহিরের কাছ।...
সাম্প্রদায়িক চক্র সম্পর্কে জহির রায়হান বহু তথ্য উদ্ধার করেছিলেন। এ কাজেই তার কাল হল। তিনিও নিখোঁজ হলেন। ম্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের হাতে তাদের সবচেয়ে বড়ো শত্রুর জীবন এভাবেই শেষ হয়ে গেল।''

জামায়াতের পত্রিকা দৈনিক নয়া দিগন্ত আর দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবস উপলক্ষ্যে নিবন্ধ ছেপেছে। সেখানে তারা বলার চেষ্টা করেছে- জহির রায়হানের হত্যাকাণ্ডের পেছনে তৎকালীন আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র ছিল এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় তাকে শেষ করে দেওয়া হয়। এমনকি তারা বঙ্গবন্ধুকেও তারা দায়ী করার চেষ্টা করেছে। জামায়াতের এই অপপ্রচারের জবাবে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের লেখাটি পড়ে মনে হল, সব সত্যকে চাপা দেওয়া যায় না। অনেক সৎ দলিল রয়ে গেছে ঘাতকদের সমুচিৎ জবাব দেওয়ার জন্য। সেগুলো খুঁজে বের করা দরকার।

নোট :
সাংবাদিক পার্থ চট্টোপাধ্যায় ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ঢাকা পৌঁছান। তারপর পাঁচমাস তিনি ঢাকায় থেকে যান। সেই সময়কার লেখা ডেটলাইন ঢাকা নামে উল্টোরথ পত্রিকায় সেসময় ছাপা হয়েছিল। পরে ২০০৪ সালে পুনশ্চ প্রকাশন, ৯এ, নবীন কুণ্ডু লেন, কলকাতা থেকে বই আকারে বের হয়।

.................................
সাংবাদিকের ডায়েরি
পার্থ চট্টোপাধ্যায়
মূল্য ১৫০ টাকা

গল্প লেখার গল্পটি

আমাকে বিপদে ফেলেছেন তিনজন। ডোবার ব্যাঙ, অমি রহমান পিয়াল এবং নুরুজ্জামান মানিক।
এদের কাউকে আমি চিনি না। চেনার কথা নয়। আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরছি। নদীতে নদীতে কাটিয়েছি। গাছপালার চিকিৎসাকর্ম কিছু জানা ছিল। লেখালেখির জগৎ নিয়ে কোন মাথাব্যথা ছিল না। এই লেখালেখি আমাকে খেল।

আমি শুদ্রবংশের ছেলে। টুকটাক লেখাপড়া আর বাপের ক্ষুদ্র ব্যবসাতি নিয়ে দিন কেটেছে। ১০০% জন্ম গৃহহীন। সেজন্য বিপ্লবের প্রতি ভরসা ছিল। বিপ্লব এলে সত্যিকারের মাথাগোজার ঠাঁই পাব। এই বিপ্লব ব্যাটাই আমাদের চোখের সামনে থেকে নাই হয়ে গেল। বার্লিন কোন সুদূরের দেশে। সেখানে একটি দেয়াল ভেঙে পড়ল। আর আমাদের বাংলাদেশের গণ্ডগ্রামের কয়েকটি হৃদয় তার নিচে চাপা পড়ল। সে রক্তপাত এখনো চলছে। হায়, ভ্লাদিমি ইলিস, তুমি কোথায়? তুমি অভিশপ্ত হও।

কবিতা লিখে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছিলাম। নদী নিয়ে কবিতাটি লেখা। ‘নদী মরে গেলে সত্য হারিয়ে যায়’। সেটা ১৯৮৪ সালের ঘটনা। এটাকে কবি মোহাম্মদ রফিক আর নির্মলেন্দু গুণ আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক উৎসবের সেরা কবিতা নির্বাচন করেছিলেন। কয়েকজন কবিজনোচিত লোকজন আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখলেন। আর বললেন, ধুস, একে দিয়ে হবে না। এ শালা গাজা খায় না। মদ খায় না। চা-ও খায় না। রাত বিরেতে হল্লা করে না। নদী টদি নিয়ে কবিতা লেখে। বাতিল।
আমি ভাই রোগাপটকা মানুষ। পকেটের চেহারা আরও খারাপ। দিন কেটে যায় একা একা। আধা খেয়ে- সাধা খেয়ে। এ রকম না খাওয়া পার্টির সঙ্গে দুএকবার সায়ংকালে ঘুরে ফিরে মাথার গোঁজার ঠাঁই হল। পরে দেখি- এরা স্টার সিগারেট টানে। আর বসে বসে ঝিমোয়। মাঝে মাঝে দুএকজন ডিম ভাজি খায়। খেতে খেতে তাদের বাড়ির সিংহ দরোজার গল্প করে। এখানে আমার মতো নাই-বাড়ির লোকজন খুবই অচল।

একটি মেয়ে একদিন আমাকে বলল, তুমি কবিতা লেখ?
আমি কিছু বলার আগেই নেতা ওকে ইশারা করে ডাকলেন। মার্কস এঙ্গেল আউড়ে বললেন, ওর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। ও বিপ্লবের অচল মাল।
কিন্তু আমি তো সত্যি সত্যি বিপ্লবকে ভালবাসতাম। বিপ্লব এলে আমার জননী যে তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালে সেটা সত্যি আমার মায়ের হত। কেউ বলতে পারত না, এটা তোমাদের বাড়ি নয়। তোমরা সর্বহারা। আহা, বিপ্লব, তুমি কেন রেড স্কোয়ারে মুখ থুবড়ে পড়লে? কমরেড ফরহাদ, তোমার নামে প্রদীপগুলো নিভে যাক।

আমি তখন কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে লোকজনের ফাইফরমাস খাটতে শুরু করেছি। এর মধ্যে এই সব ঝিম মারা বিপ্লবীরা কোন ফাঁকে আমার নামে একটা পোস্টার সেঁটে দিল- কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক পদে এই গোবেচারাকে ভোট দিন। আমি এসব জানতেই পারিনি। আমি তখন মধুপুরের জলছত্রে। কুষ্ঠ আশ্রমের পাদ্রী মহাশয়দের সঙ্গে ঈশ্বরের বাক্য পাঠ করছি- আর প্রভুর দুই নম্বর মেষ হয়ে ফ্রি খাওয়া খাচ্ছি। কারা কারা যেন যথাযোগ্য লোক না পেয়ে আমার মতো গোবেচারাকে সিল পিটিয়ে দিল। ভোটগুলো জলে পড়েছে। ছাত্র সংসদ যে আগামী দিনের ঘড়ের মাল তৈরির কারখানা এটা বুঝতে আমার সময় লাগল না। সদাপ্রভু আমাকে রক্ষা করলেন। ওরা বলল, এই লোকটা চাঁদাবাজি ছাড়া বিপ্লব করতে চায়। হা হা হা। বেঁচে থাকুক তাহাদের এই হা হা হা।

কিছুদিন পরে একজন প্রফেসর জিজ্ঞেস করলেন, বৎস, তুমি এই নিউটনী কোটখানা কোথায় পাইয়াছ?
বলিলাম, আমার সঞ্জীব দিয়াছে।
-এই শার্টিটি কাহার?
-বাতেনের।
-এই ঢলঢলে প্যান্টটি?
-কোনো মাদামোয়াজেলের নহে আর্যে। উহাও একজন বন্ধু মাসুদের। তিনি কিঞ্চিৎ ফাউভোজী।
-মোকাসিনটি?
-মুচির দোকান হইতে ভাড়া লইয়াছি। দৈনিক পাঁচসিকা।
-মার দিয়া কেল্লা। প্রিয় ভদ্রে, তোমার প্রিয় কর্ম কি?
-ঝিমানো।
তিনি রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, পারফেক্ট। সিভিল সার্ভিসের জন্য ইহার যোগ্য আর কেহ নাহি। যাও বেটা। উপজেলাজেলায় যাও। ঘাস কাটো।

আমি দীর্ঘ পনেরটি বছর গ্রমে গ্রামে ঘাস কেটে বেড়িয়েছি। এই ঘাসের বর্ণ আমার মর্মে গেঁথে গেল। আহা আর্যে, প্রফেসর এবিসিডি আপনার টাকে অতি সুচিক্কন ঘাস গজাক।

গজানোর আগেই সদাপ্রভু তার এই নাদান মেষশাবককে প্লেনে তুলে দিলেন। কহিলেন, ওহে বৎস, নয়ন মেলিয়া দ্যাখো- হুই যে হাডসন নদী। ইহার ভিতরে আমি হস্ত উত্তোলনপূর্বক দণ্ডায়মান হইয়া স্বপ্ন বিতরণ করিতেছি। চাহিবামাত্র বাহককে দিতে বাধ্য থাকিব।
স্বপ্ন দূর থেকে দেখা ভাল। কাছে গেলেই বিপদ। স্বপ্নকে দেখে বড় বিস্মিত হলাম। বিস্ময় ভাঙতে সোজা হাসপাতালে। ডাক্তার ধীরে ধীরে আমার কানে কানে কহিলের, প্রিয় বয়স্য, অচেতনে কি কহিয়াছ একটু বুঝাইয়া কহিবে কি? তিনি একটি টিপ রেকর্ডার চালাইয়া দিলেন। শুনি, কোন এক আমি কহিতেছি- রূপ নারাণের কূলে জেগে উঠিলাম। জানিলাম এ জগৎ স্বপ্ন নয়। সত্য যে কঠিন। কঠিনেরে ভালবাসিলাম। ডাক্তার অনেক কষ্টে এই কথাগুলি অনুবাদ করে তার দরোজায় টানিয়ে দিলেন। নিচে লিখেছেন আমার নাম। আঁতকে উঠলাম। বললাম, বেটা ভগুচগু, ওটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা।
রভীন-ড্রন- নাট? উহাকে চিনি না। যে ব্যাটার নাম খটোমটো তাহাকে আমার দরকার নাই।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে আমার দরকার। জীবনের প্রতি পদে পদে দরকার। আকণ্ঠ যন্ত্রণায় ডুবে তিনি আনন্দ ছেঁকে এনেছেন। এ লোকটাই আমাকে বুঝেছেন।

এই সময় আমি হাঁটতে ভুলে গেলাম। খাওয়া দাওয়া ঘুম- বিলকুল গায়েব। কোথাও কোন ক্রন্দন নেই। শুধু আমার ভিতরে আছে। সেকি বাঁচার জন্য? না, মরে যাওয়ার জন্য –জানি না। শুধু জানি মাঝে মাঝে আমি মরে যেতাম। ডাক্তার তখন বলতেন, প্রিয় বয়স্য, দ্যাখো- তোমার মেয়েদের চেয়ে দ্যাখো। আমি তখন বেঁচে উঠতাম।
আমার মেয়ে দুটি শান্ত। ডাল খায়। ভাত খায়। ছোট মেয়েটি বলল, জানো বাবা, ক্যান্ডি খেতে আমার ভাল লাগে না। দাঁত নষ্ট হয়। বড়োটি নভেল লেখা শুরু করল। পাঁচশত পৃষ্ঠা লিখবে। এই ঢাউস নভেল প্রকাশিত হলে প্রকাশক অনেক ডলার দেবে। ডলার ছাড়া সংসার অচল। ঠিক এ সময় আমার স্ত্রী চাকরী হারাল।

আমি ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করেছি। হেঁটে হেঁটে কাজে যাই। দেখতে পাই- আমি একা নই। দুইজন লোক। একজন অসীম যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। পিছন থেকে আরেকজন কানের কাছে বলেই যাচ্ছে- থেমো না। হাঁটো। হাঁটতে থাকো। সামনের মানুষটি আমি। পিছনের মানুষটিও আমি। দুজনেই ক্লান্ত। শ্রান্ত। অবসন্ন।


এইসব দিনে অনন্ত দুঃখের মধ্যে আমি একটি অক্ষর লিখি। লিখি দুটি অক্ষর। কাঁপতে কাঁপতে লিখি একটি শব্দ। পূর্ণ একটি বাক্য। মরে যেতে যেতে লিখি একটি পাতা। এক পাতার গল্প। দীর্ঘশ্বাসের। বেদনার।আর হাহাকারের।
কেন জানি ডোবার ব্যাঙ আরেকটি গল্পের আবদার করে বসলেন। তার ভঙ্গিটি আমাকে আরেকটি গল্প লেখাল। ডাক্তার দেখেশুনে বললেন, ওকে। চালিয়ে যাও। থেম না। আমার মেয়ে দুটি আমার পাশে বসে লিখতে শুরু করে দিল। লিখতে লিখতে বলল, বাবা, লেখ বাবা।
লিখতে লিখতে দেখি, আমাকেই লিখছি। লেখার মধ্যে দিয়ে কোন এক আমি উঠে আসছে। ছেঁড়া খোঁড়া। পরাজিত। শুদ্র মানুষ। গৃহহীন মানুষ।

অমি রহমান পিয়াল উস্কে দিয়ে বললেন, একাত্তরকে নিয়ে লিখুন। বাহাত্তরকে নিয়ে লিখুন। পচাত্তরকে নিয়ে লিখুন।
এগুলোতো লিখছেন অমি রহমান পিয়াল। নূরুজ্জামান মানিক। ওদের লেখার মধ্যে দিয়ে ইতিহাস কানাগলি থেকে বেরিয়ে আসছে। অণ্ধকারের ভিতর থেকে ভাঙাচোরা আলো ফিরে আসছে। পথ দেখতে পাচ্ছি।

এই পথ দেখতে পাওয়াটা বিপদ। পথ জানা থাকলে আবারো বিপ্লবের ফেরার সম্ভাবনা জাগে। আবার মনে মনে আশা জেগে ওঠে- আমার মায়ের তুলসী তলাটি ফেরত পাওয়া দরকার, যেটি তার নিজের। কেউ তাকে বলবে না, তোমার কিছু নেই। শূন্য।

হায় শূন্যতা, তুমি আর কতকাল রহিবে আমাদের ঘাড়ে?

...................
কাকমানুষের চকখড়ি
গল্পগ্রন্থ
প্রকাশক : আমার প্রকাশনী।

স্টাইল নিয়ে কিছু কথা

আন্তন চেকভ একটি চিঠি লিখেছিলেন গোর্কিকে। বলেছিলে--'তুমি একজন আর্টিস্ট। তোমার অনুভব-ক্ষমতা অসাধারণ; তোমার কাছে অনুভূতি আকার পায়। যখন তুমি একটি বস্তুর বর্ণনা দেবে, তখন তুমি যেন তা দেখতে পারো আর হাত দিয়ে ছুঁতে পারো। এই হবে যথার্থ লেখা।'

ভাষা হবে লেখকের ক্রীতদাস, আদেশ মাত্রেই তা কার্য সমাধা করবে, লেখকের অনুভূতি বা চিন্তাকে সাকার রূপ দেবে। এখানেই লেখার স্টাইলের চরম সার্থকতা। এরই জন্য লেখক দিনের পর দিন সাধনা করেন।
যে-কোনো গদ্যরচনা বা কবিতায় লেখক ব্যক্তিত্বের এমন-সব গুণ ও বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়, যেগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখানো যায় না, অথচ অনুভব করা যায়, এবং সেইসব গুণের যোগফল লেখক-ব্যক্তিত্ব, এমত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, তাকে এক কথায় বলা যায়- স্টাইল।
স্টাইল হচ্ছে লেখক মানুষটি।

ফ্লোব্যের বলেছেন, স্টাইল হচ্ছে লেখকের বিভিন্ন বস্তুকে দেখার বা চিন্তা করার একান্ত নিজস্ব ভঙ্গি। স্টাইল ভাষার এমন একটি গুণ যা লেখকের বিশিষ্ট চিন্তা-ভাবনা-অনুভূতিকে অব্যর্থভাবে যথার্থ্যের সঙ্গে পাঠকমনে পৌঁছে দেয়। পাঠকমনের সঙ্গে লেখকের যোগাযোগের সেতু। শব্দ, বাক্য, চিত্রকল্প, অলংকারের অবরণ-মণ্ডিত যে লেখক-ব্যক্তিত্ব, তারই নাম স্টাইল। তা ব্যক্তির পোষাক নয়, তার রক্ত মাংস আর হাড়।

স্টাইলের ছয়টি গুণ :
স্বচ্ছতা, সরলতা, পরিমিতি, বৈচিত্র্য, নাগরিকতা ও সরসতা।

মনোভাব প্রকাশেই ভাষার সার্থকতা। একজন অন্যজনের কাছে তার মনোভাব প্রকাশে ভাষার সাহায্য গ্রহণ করে। স্বভাবতই ভাষা যত স্বচ্ছ হবে স্পষ্ট হবে, মনোভাব ততই স্পষ্ট হবে।

বঙ্কিম চন্দ্র বলেছেন--যিনি সোজা কথায় আপনার মনের ভাব সহজে পাঠককে বোঝাতে পারেন তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক। লেখার উদ্ধেশ্য পাঠককে বোঝানো। এটা সরলতা।

অতিকথন বর্জন করে মিতভাষণে, অসংযত ভাবোচ্ছ্বাস বর্জন করে আত্মসংযত পরিমিত বক্তব্যে উপনীত হবার সাধনাই স্টাইলের সাধনা।
লেখায় বৈচিত্র্য থাকতে হবে। বৈচিত্র্যহীন তীক্ষ্ণাগ্র সংহত চিন্তাসমৃদ্ধ রচনা অনেক সময় পাঠকমনের এতবেশি মনোযোগ ও আনুগত্য দাবী করে যে রচনার মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়।

চিত্তবৃত্তির বাহুল্যবর্জিত আভিজাত্য, বুদ্ধিপ্রবণ মননশীলতা, যুক্তিধর্মিতা ও প্রাণের সজীবতা নাগরিকতা-গুণের লক্ষণ। এর বিপরীত কথা হচ্ছে গ্রাম্য বা অশ্লীলতা। যে কথা শুনে লজ্জা ঘৃণা অথবা অমঙ্গলের আশংকা উদয় হয়, সে বাক্যই অশ্লীল। সহৃদয় সামাজিকের (কালচার্ড মানুষ) মনে যদি লজ্জা বা ঘৃণার ভাব জন্মে, তবে উৎস যে রচনা, তা অশ্লীল, গ্রাম্য। গ্রাম্যতা হল- চিত্তের অনুদারতা, দৃষ্টির সংকীর্তনতা, যে কোন পরিবর্তনের প্রতি বিমুখতা, শ্রেষ্ঠাত্বাভিমান।

সরসতা গুণের জন্ম লেখকের সহাস্য রসিকতায়, উদার জীবনদৃষ্টিতে, জীবনসম্ভোগের আনন্দে। এই গুড হিউমার দেয় বা সরসতা লেখাকে দেয় স্বাদুতা, পাঠকের মন ভরে ওঠে এক অনাস্বাদিতপূর্ব আনন্দে। অসূয়া, ঈর্ষা, দ্বেষ, ঘৃণা, ক্রোধ, জুগুপ্সা এই সরসতার বিপরীত।

মলিয়েঁর তার কোন লেখা শেষ করেই তার রাধুঁনীকে পড়ে শোনাতেন। রাঁধুনিটি ছিল অশিক্ষিত। রাঁধুনীটি যদি হেসে উঠত তবে বুঝতেন লেখা ঠিক হয়েছে। সার্থক হয়েছে। তিনি কোনো পণ্ডিতের কাছে যেতেন না।


খুব দরকারী একটি বই কিনুন-
বাংলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাস
অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়