Tuesday, February 9, 2010

পনেরটি কবিতা : অন্যস্বর

মোস্তাক আহমাদ দীন
পাখি

শরীর খুলছি
কতটা লিপ্ত হয়েছে দেখি বাতাসের ব্যথা ও ছত্রাক
আর শীতপীড়িত আমি উড়ছি বালুতীর থেকে

বলছে উড়–ক্কু বন্ধু
‘জলে ডুববার স্মৃতি আজ
চিত্রিত করতে পারো জল-তেল রঙে’
তখন শরীরে পাচ্ছ
সমগ্র চাঁদবণিকের দেশ

আমার আসবার-কথা পথে প্রচারিত

আমি উড়ছি
আমার বঙ্কিম লেজে লেপ্টে রয়েছে অসংখ্য উদ্গান
আমার হৃদয়ে যদিও জেনসন্তের স্থিতিস্থাপকতা
হয়ত তাহারো অস্থির নিধি জলে ঘুরে মরে
হয়ত তার দেহগাছে জলের শিকড়
তাহার অশেষ গানে
সোম কিংবা অতিলোকগানের সহজ ভণিতা
ফলে দেখছে
এক অন্ধ জাতিস্মরের অনন্য নিদ্রা

আমি চুম্বন করছি
আর ছুঁয়ে যাচ্ছি নিচুপাহাড়ের শান্ত গণ্ডদেশ
কেশর উড়ে চলেছে হাওয়ায়
দাঁড়া-য় মেঘমাত্র নেই
পাখনার ভারে এই ঘুরে-চলা

পাখিজন্ম পাঠ করছে পথের মানুষ



তুষার গায়েন
বাউল গাইতে পারি যেন

ঠাকুর্মা গল্পের মত কথা বলে যেন এক পৌরাণিক পাখি
গেয়ে ওঠে গান, কণ্ঠে সোনালী তরঙ্গ তার পাকা ধান হয়ে ঝরে
ঠাকর্মা ধানের কথা বলে- কতদিন বলেছে এমন!
ধানগুলো ধীরে ধীরে আঁধারের গায়ে সাদা খই হয়ে ফুটে গেছে
স্বপ্নের মতোন ঝ’রে গেছে তারপর ঠোটেঁ তার সাদা খই
ঠাকর্মা হাঁসের গল্প করে- খইরঙা রাজহাঁস কোমল মেঘের মত
উড়ে গেছে কবে, মেঘ হয়ে ঝরে এখনও- ঠাকুর্মা মেঘের কথা বলে
সাদা কালো মেঘে নাকি হয় সখা মিলন গভীর!

মেঘের মিলন গাঢ়- মোটাবৃষ্টি, ঋজুরোদ সব
ঝরেছে অনেক তার, ছেনেছে অনেক আর মরমের মাটি তার
ভিজেছে অনেক বহু বাসনা মনের তাই হলুদ শর্ষের ক্ষেত ধূ ধূ
প্রগাঢ় সবুজ ধান; শান্ত গাভী, শিশু তালগাছ- নিমছায়া
খালে জল বেয়ে গেছে ধারাল প্রখর গেছে বয়ে লোনাজল
সারি সারি শুপুরীর শেকড় ছুঁয়েই, সীমিত ডোবায় মিশে একাকার
সেইখানে কালো কই, সতেজ মাগুর মাছ করে গৃহবাস
তেলের তাপিত ঘ্রাণে মৌ মৌ উঠে গেছে ঠাকুর্দার স্বাদু ঠোঁটে
ঠোঁটে তার ঝরে শুধু ভোজনের স্মৃতি :

ভোজন উৎসব হবে তাই, ছায়ারাত- ছায়ার আঙ্গিকে গাছ
পাতায় পাতায় মিহি নকশার ছাপ সুগন্ধী উঠোন জুড়ে ফুটে ওঠে
পুন্নিমা আলোয়, ডাকে লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা, পিঠার শরীরে কারুকাজ-
নারীর কোমল হাত, ঘিয়ের প্রদীপ শত কাঁসার বাসন আর অনেক মানুষ
ঠাকুর্দা আহ্লাদে বলে, কই মাছের মাথার মধ্যে থাকে বারোতীর্থের জল, ওগো!
বৌমা, পাতের ওপর ওই মাথাটা দিলে না কেন, দাঁত না হয় গেছেই ঝরে।

এখন ভোজন বেশি নেই আর তাই ঠাকুর্দা বৃথাই অত ভোজনের কথা বলে।
বাসনা এখন বেশি বেঁচে নেই আর ঠাকুর্মা কেবলি বাসনার বার্তা দেয়।

বাসনার শেষকৃত্য হয়ে গেছে শেষ!
তবে এই সাধ কেন, এইসব ছবি কেন?
ছবি সব যায় নাতো চেনা, স্মৃতি তার যতই থাকুক…
পিতার নীরব কণ্ঠে এইসব কথা ঝরে পড়ে, যেন চিটাধান ঝরে
পিতার নীরব কণ্ঠে চিটাধান ঝরে। ঝরে কেন?

পিতা নিরুত্তর- শুধু হেঁটে যায় ধীরে কোদালটা নিয়ে কাঁধে
মাঠের এ আল থেকে ও-আল, ও-আল থেকে দূরে, ও..ই দূরে
পথের কিনারে তালগাছ, নিথর দুপুররোদে হেঁটে যায়
কোনো গাঁয়ে গঞ্জে নেয় তাকে কিনে কেউ সারাটা দুপুর ভর


পিতার নীরব কণ্ঠে তাই শুধু চিটাধান ঝরে।

আচমকা এক তরুণ বাউল রুদ্রপায়ে উড়ে আসে যেন, কণ্ঠে তার
মেঘের গর্জন বেজে ওঠে তুমুল ঝংকারে, গেয়ে যায় অগ্নিঝরা অবিরাম
জ্বলে যায় বাসনার শব, জ্বলে যায় বিগত বিলাস- ক্লান্ত হতাশ্বাস জ্বলে যায়…
একবার জ্বলে গেলে নেভে না কখানো তাই, ফুটে ওঠে লালফুল বাউলের হাতে।

আমি তবে গাইব বাউল!

সুধীজন, এই আশিস দেবেন মোরে
বাউল গাইতে পারি যেন মোর সারাটা জনম জুড়ে!!



আবু সাঈদ ওবায়দুল্লাহ
হাঁস
....
নিরাময়ের জন্য হাঁস। নিরাময়ের জন্য শাদা জলদুহিতা।
প্রাণীজগতের এই অজাতশত্রু আলো আমাদের উপলক্ষ্য।

বহুদিন পর জলের ভাঙ্গন শুনে বুঝলাম
এটা আর কিছু নয়, শাদা পালকের ছোট্ট পাখি
ডানা দুলিয়ে দুলিয়ে আসছে।
স্থলবাসী ফুল, অনেকদিন আত্মীয় ছিলো
আজ কোন জঙ্গলের গাছ
তাকে ডেকে নিয়ে যায়।
জানি ডিম্বানুতে পরাশ্রিত শুক্র
জন্ম দেবে শিশু- অপর পক্ষের।

তাই নিরাময় প্রয়োজন। জলে হাত দিয়ে বুঝি
আর একবার উপস্থিতি প্রয়োজন।
ছোট্ট পালকের ভারে আমাদের স্থল-অবস্থান
পুনরায় নির্বাচিত হোক।
একদিন জলভ্রমণে গিয়ে দেখবো
আমরা সবাই অজাতশত্রুর শিষ্য।




খলিল মজিদ
একাকি সমাবেশ
..............
(হুমায়ূন আজাদ, ধন্য তার সাহচর্যের স্মৃতি)

আমরা এক সত্যবাদীর সমাধি খুঁজতে বের হই
সত্যিই এক সত্যবাদীর স্বপ্ন দেখতে বেড়াতে যাই
বুঝি, সত্য শুধু ঘটমান, সমাধি তার নাই
খুঁজে পাই রাঢ়িখাল, ছড়ানো শিউলি ফুল
শাদা শাদা কথায় মুখর আড্ডা বসে থাকা;

সময় আমাদের চুরি হয়ে যাচ্ছে অন্ধ এক সুড়ংয়ে
কে বলত, কে?
- কবর যার কালো ডোরা শাদা এক বাঘ।
এই আমাদের কাল, সে কলি, না কালো
হিসেব করেনি সে
সময়কে সে বুঝেছিল পুরাকালের মর্মে
কিন্তু সময় ছিল কালো এক চিতা
আর তার বুলি, কলি কালের বাহানা;

সমকালের আত্মার চিৎকারে পুরা থাকে পুরাকালের অভিজ্ঞান
কে জানতে পেলো, কে ?
- মৃত্যু যার প্রশ্নের মিছিল, সমাধি যার একাই সমাবেশ;

ক্ষীণস্তনা মেয়েদের রাধা বলতে দ্বিধা
করতো কে ?
- স্বপ্ন যার বিদ্ধ হলো চিতার কালো দৃষ্টিতে

কয় পুরুষ ধরে আমরা মাথায় করে করে
কয়টি মাত্র শব্দের অর্থ দাঁড় করলাম
পিছনে ছিল অন্ধ চিতার অভিশাপ
কে দেখতে পেলো সবচে’ ভালো, কে ?
- কবর যার বকুলতলা, বক্তব্যভরা দু’খানা বই।





মুজিব মেহদী
বিড়ালটি
............

তোমরা চলে যাচ্ছ, ট্রাকে মালামাল উঠে গেছে সব, এক জীবনে মানুষের কতবার যে বাড়িবদল জরুরি হতে পারে মানুষও বুঝি তা জানে না

একদিন এভাবেই ট্রাকে মাল বোঝাই করে রেলিঙ ঘেরা এই বাড়ির একতলায় তোমরা নোঙর ফেলেছিলে-- অতিথি পাখি ও গৃহস্থ বিড়াল একদিন ভোরবেলা চার সদস্যের একটি নির্ঝঞ্ঝাট পরিবার দেখে আহ্লাদে উল্লাস করেছিল

তোমরা ত্যাগ করে যাচ্ছ একটি অভ্যস্ত পরিমণ্ডল, তার বিয়োগ ব্যথায় তুমি কাঁদলে তোমার মা কাঁদল, ট্রাকের সিটে গিয়ে বসলে সবাই, তুমি, তোমার মা, ছোট ভাই, কুমারী আত্মীয়া-- বাবাকে তো আগেই রেখে এসেছ অনিবার্য মাটির বিছানে

গাড়ি স্টার্ট নিতেই তাড়াতাড়ি হাত নাড়লে তোমরা সবাই, শেষবার তাকালে, বাড়িওয়ালা অনুভূতিহীন, তখনই টাঙিয়ে দিচ্ছেন ভাড়াটে ধরার ‘টু লেট’ বাহানা, ঘরে জল ঢেলে ধুয়েমুছে দেয়া হচ্ছে তোমাদের সুদীর্ঘ ছোঁয়া

সব মায়া কাটিয়ে বাধ্য হয়ে তোমরা শহরান্তরে যাচ্ছ, পেছনে কাজলা বিড়ালটি দৌড়াচ্ছে... দৌড়াচ্ছে... দৌ...ড়া...চ্ছে




তাপস গায়েন
ইচ্ছামৃত্যু
......
বছরের হ্রস্বতম দিনে, এই দেহে লিখে রেখে মুক্তি, আমি যাই শীতনিদ্রায় । সময়ের তীর, প্রেম, আর হারপুন এসে বিদ্ধ করুক আমাকে,কিন্তু আমি থেকে যাব প্রতিরোধহীন নিশ্চুপ জ্যোৎস্নার প্লাবিত দিগন্তে, সেখানে উড়ুক পৃথিবীর সব পরিযায়ি পাখি, উৎসারিত হোক তাদের যাত্রাপথের সকল অভিজ্ঞান । কিন্তু আমি থেকে যেতে চাই মুক ও বধির দক্ষিনায়ণের হ্রস্বতম এই দিনে, বরফ-আচ্ছাদিত পৃথিবীর পথে ।
পরিযায়ি পাখিদের ডানায় আবর্তনশীল সূর্য এখন নিরক্ষরেখার অতি কাছাকাছি, আর আমি আছি তার অধিবিদ্যায় ।পরিভ্রমণ শেষে এখন বিষণ্নতা জেগেছে । অসংখ্য যুদ্ধশেষে, আমার ক্ষত আর অন্যায় যেসকল নারী তাঁদের দীর্ঘ চুলে আর করুণায় মুছে দিয়েছিল একাধিক দিন, সেই উজ্জ্বল নারীরা এখন কোথায় ? বোধকরি, তাঁরা আছেবালিয়াড়িময় কোন গৃহে কিংবা জলাঙ্গীর কোন তটে কিংবা বরফ-আচ্ছাদিত পৃথিবীর কোন পথে । হৃদয়ের বিভূতিতে, বোধকরি, তাঁরা আজো জ্বালে মঙ্গলদীপ অন্য কোন গৃহে । সেখানে ওঠুক জেগে প্রেম, প্রাণের প্রাচুর্য, আর বোধিবৃক্ষ । কিন্তু আমি আছি শীতনিদ্রায় ; পরিযায়ি পাখিদের ডানায়, আবর্তনশীল সূর্যের রথে ।
যদি চাই দেহত্যাগ উত্তরায়ণে, তবে আরও একবার অনুভবে বুঝে নিতে চাই পৃথিবীতে চুম্বকের বেগ, রণনীতি, উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কের নীচে বাতাসের প্রবাহ, পাতাল ট্রেনে অন্ধ গায়িকার গান, আর অভিমুখ সমুদ্র তরঙ্গের । তবু, মাঝে মাঝে ভাবি, কেন এসেছিলাম এই পৃথিবীর পথে । আমাকে করেছে বিদ্ধ যাঁরা অপূর্ব শরশয্যায়, বোধকরি,আমার অপূর্ণ প্রেম থেকে তাঁরা জাত ।
পরিযায়ি পাখি, দক্ষিনায়ণ থেকে উত্তরায়ণে তোমাদের এক যাত্রাপথ শেষ হ’লে, আমি চাই দেহত্যাগ ; যেতে যাই বিস্মৃতির পথে । তবু, ব্যাপ্ত হোক এ পৃথিবী, যেভাবে হয়েছে ব্যাপ্ত রক্তে, প্রেমে, যুদ্ধে, আর মানুষের যৌথ গানে ।



পলাশ দত্ত
নিজের মুখে হাত দিয়ে অবাক হয়ে যাই
.........................

নিজের মুখে হাত দিয়ে অবাক হয়ে যাই
যেখানে হাত পড়ে সেখানেই হাড়-
কপাল থেকে চিবুক, এমনকি গাল;

মুখের এই চামড়া তবে সত্যি নয়!
মিথ্যা মোহে ঢেকে রাখে
অপ্রিয় সব শক্ত শক্ত হাড়?

চামড়া-ঢাকা পুরো মুখ
মিথ্যা-মিথ্যা লাগে-
হাড়ের সাথে দ্যাখা, কখনো কি আর
কবর না-খুড়লে হবে?




অদিতি ফাল্গুনী
পুরনো গলিতে
.........
পুরনো গলিতে এলে,
রিকশা ভুল করে চলে পুরনো বাড়ির দরজায়,
রিকশাকে থামাতে ভুলে যাই...
পুরনো গলির মোড়ে নিরন্তর সব্জি কিনছেন মা...
পেঁয়াজ, কাঁচামরিচ, আলু, কলা,
কখনো বা রুটি, ময়দা, চিনি কি চাপাতি

এই মার্চে বাসা বদলেছি,
পুরনো গলির ভোরে এসেছিল সাদা অ্যাম্বুলেন্স,
আরও সাদা চাদরে মায়ের দেহখানি -

পুরনো গলির ঘরে মা’র রান্না চলে নিরন্তর,
মাছ আর আনাজ কোটেন,
কেটলিতে চায়ের জল ফোটে,
বিছানার চাদর বদলান, বালিশের খোলেন ওয়াড়...

আ-র আ-র
সারাটা বিকাল জুড়ে থাকে
ছেলেদের চিঠির অপেক্ষা,
ছবির, প্রবাসী মেয়েদের।
অপেক্ষা করেন আর রান্না...
আর হিসাব লেখা,
বাজারের হাজার হিসাব...

আলু এক কেজি আর এক কেজি পটোল,
গরম মশলা-চিনি-সুজি...
পুরনো গলির মোড়ে নিরন্তর মা’র সব্জি কেনা,
এই মার্চে বাসা বদলেছি...

আমরা, যারা আজন্ম ভাড়াটে,
আমরা, যারা চির-যাযাবর,
এই বাড়ি থেকে ঐ বাড়ি,
এ-শহর থেকে ও-শহর...

পুরনো বাড়িতে আজ নতুন ভাড়াটে,
জানলায় নতুন পর্দা, নতুন আসবাব,
নতুন চাদর আর বালিশের নতুন ওয়াড়।

নতুন বাসায় মা’কে কোথাও পাই না,
নতুন ডিসটেম্পার, নয়া লোকেশন,
নয়া পাড়া-পড়শি, পরিজন...

পুরনো গলিতে এলে,
রিকশা ভুল করে চলে পুরনো বাড়ির দরজায়,
রিকশাকে থামাতে ভুলে যাই।



জাহানারা পারভীন
ক্ষমার পুকুর ক্রমশ ছোট হয়ে যায়
.........................
আহত মাকড়সার সামনে একটি দুপুরকে বহুদিন নতজানু হয়ে
বসে থাকতে দেখেছি। বসার ভঙ্গিটি চরে কুমিরের রোদ পোহানোর
মতো আয়েশি। নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায় এর পেছনেও আছে কোনো
শানে নযুল। মিছিলের দ্রুতগামী পায়ের নখে যতটা প্রাসঙ্গিক ধুলোবালি;
তার মতোই হতে পারে এর মানে। একটি দুপুরকে বহুদিন প্রশ্রয়ে প্রশ্রয়ে
পরিণত হতে দেখেছি বিকেলে। অতঃপর সন্ধ্যায়। রাত্রির কাছে অবশ্য কোনো
ক্ষমা নেই; কেননা, আমাদের বনসাই মনে ক্ষমার পুকুর ক্রমশ ছোট হয়ে যায়।



বিজয় আহমেদ
শীতের কবিতা
............
শুনছো তো এ শীতকালে, খেজুরবাগানের উষ্ণতা হতে
উড়ে আসা বেপেরোয়া গন্ধের মায়ার সাথে
ঝগড়া করছে তোমার বউ

তোমার বউ,
যে মূর্খ-সুন্দরী এবং কামগন্ধময়
যে কফিতে ঠোঁট ডুবিয়েই ভুলে যায় গ্রাম- রঙধনুর স্মৃতি

বলো তার কেন এতো মিহিন-মুগ্ধ
ঝগড়া আর বিবাদ
খেজুর বাগানের উষ্ণতার সাথে?




ওবায়েদ আকাশ
বৃষ্টি পড়ছে
........
ঐদিকে, সীতাঘাট ধরে বৃষ্টি পড়ছে
শুল্কের বাজার পড়েছে, পদ্মায়
ভালো জন্মেছে ইলিশের পোনা

ধনেশের মেয়ের সম্বন্ধটি ভালোই ঘটেছে
পলকে রটেছে বাবা
মোটা ভাত মোটা কাপড় ক’জনার জোটে আর !

পরিশ্রমী গাভীগুলো বান উজাড় করে দুধ দেয়, প্রত্যুষায়
ভরে ওঠে কাঁচা সবজির ঝুড়ি - অলক্ষ্যে -
পাড়ার স্কুলঘরে ফি-বার্ষিক সম্মেলন হলো :
শিশুদের জন্য চাই প্রস্ফুটিত গোলাপের বাগান
স্বাস্থ্যকর খেলার সামগ্রী
দীর্ঘতম মাঠ

তোমার জন্য প্রবাহিত দ্বীপান্তরের হাওয়ায়
এ খবর পৌঁছে যাবে

একটি মাত্র ইলিশের বিনিময় হলে
মিটে যাবে সমস্ত পারাপারের দেনা



টোকন ঠাকুর
মম বন্ধু তরে
...........
পাত্রে জল রেখে তাতে দেখতে পাই মুখ
পাত্রটি উনুনে দাও, মুখের
ছায়াটি পড়ুক

বহুপাত্রে বিভাজিত
যত যত যত,
প্রতিকৃতি দেখেছি যা
এক-একদিনের ক্ষত...

এক-একদিনের যৌবনিকা এক-একদিকে যায়
পাত্রে জল রেখে তাতে
পষ্ট দেখতে পাই?

এই পাত্রের পাড়াপড়শি
ভাঙা আরশি আলো,
উনুনে মুখ পুড়ছে, তাতে
হঠাৎ যে চমকালো!-

তার মুখে ফুল, ধূপচন্দন... এস্রাজে ভৈরবি
ধীরক্রমে রুগণকুসুম
পাপবিদ্ধ কবি?

মম, পাত্রে জল, জলাঙ্গিতে
একটুখানি পরেই
অগ্নিভষ্ম অঙ্গারীয়
কবিতাধীন ঘরে-
বুঁদ হওয়া তার লাল চক্ষু লাল যৌবনিকা!

উড়ে যাচ্ছে ঝরাপাতা, বনে বনে
সহস্র পাঠিকা...



লুবনা চর্যা
ও লেজ কাটা ঘুড়ি,যতো খুশি উড়
......................
কোথায় যে যাই! মাঠভরা লাটিম ঘোরে তোর চোখের জঙ্গলে, আমি চেনাজানা চাঁদ আর কুয়াশর ঘর এখন ইচ্ছে করে ভুলে যাই। যে ঘর অন্ধকার কিন্তু খুব ধোয়া ওঠে, নদী থেকে ফেরার পথে একটু থামি সন্ধ্যার ডানা ভাজ করে।

যে তুই নিষ্ঠুরতায় হার মানাস কোনো শিকারী পাখিকে, অকারণে আমি ফিরে যাই তারই নিষ্পৃহ অনমনীয়তার দিকে। চিরহরিৎ বনে কল্পনার পাতা কুড়াতেও হঠাৎ কান্ত লাগে। ইমেজের সরাসরি প্রাপ্তি ছাড়া সবকিছু স্তিমিত হয়ে যাচ্ছে।

কিংবা যখন মৃত ও জীবন্তের পরিবেশে সমন্বয় করে ফেলি আর নিজেকে নিমজ্জিত হতে দেখি নাবিকের ছুড়ে দেওয়া ভোতা অ্যান্টিকাটারের মতো নীল অতলে, তখনই জিজ্ঞাসার প্রাণবন্ততা হারাই। বহু বহু দূর ছুটে মেঘের দলটা বুঝতে পারে, বাতাসের তারনা ধারণাটাই আদতে উড়–ক্কু....

তাই রৌদ্রচিলের সাথে বেদনাকথা উজাড় করতে যাই না আর গহীন আকাশে। ধীরে ধীরে বিদেহী জীবানুরা আমাকে গ্রাস করছে। তাদের প্রিয়পাত্র হই বৈপরীত্যে, উদ্ভট প্রেম-প্রকরনে।
আভপীড়নের কারণেই বেশিদিন যুদ্ধপ্রবন মৎস গোত্রে অবস্থান করা হলো না। যদিও গীতা এ সম্পর্কে ভার লাঘব করতে পারে অনেকখানি, তবু ওসব ধুনফুন চাতুর্যে আমার পোষায় না।

সমুদ্র আর আকাশের রং যেখানে একই ব্রাশ দিয়ে ঘষা হয়, আমার ইচ্ছামৃত্যু সে দেয়ালের অভ্যন্তরেই নিরাপত্তা পায়। আমি পারফর্ম করি পারলৌকিক আবেগগুচ্ছের।

শুরু ছাড়া শেষ করা যায় না বলে মানুষেরা প্রত্যেকেই ক্ষুদে ঐতিহাসিক। তারা সৌন্দর্যসচেতন করার জন্য আমার হাতে একটা আয়না এনে দিয়েছে, বিনিময়ে প্রত্যাশা করেছে কিছু মানবিক পারিশ্রমিক। হয়তো এবার জন্মদিনেও আত্মহত্যা করা হবে না !

চূড়ায় চূড়ায় ফুটে থাকা কদম, কৃষ্ণচূড়া, জারুল বা রাধাচড়া আমাকে যে উচ্চতর অনিবার্যতার প্রজ্ঞা দিয়েছে- তা পরাজিত হউক আমি চাই। চলমানতা নৈরাশ্যের ঢেউ দ্যায় বলে আমি নেতিবাচক ভাবনা ভাবি। আমি নেতিবাচক ভাবনা ভাবি বলেই বিয়োগান্তক বৃষ্টির ছড়াছড়ি!

অগ্নিকান্ডে জাহাজ ডুবে গেলে বরপের স্তুপে কালো ছাতার মতো অসংখ্য গম্ভীর ভ্যাম্পায়ার চলে আসে। তারা প্রার্থনা করে তোর আত্মা এবং দেহ। অথচ গভীর অস্বীকৃতি জানালে তুই হতে পারবি তো বিপন্নতামুক্ত।

সূর্যঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়ে রেখেছিলাম, রাত ১২ টায় সে আমাকে জন্মদিনের মিউজিক শোনায়। মৃত্যু-তন্ময়তা ভেঙে গেলে শরবনে ছুটি কিছু বাশি তৈরির জন্য। বন্ধুরা এলে সবাইকে একটা করে দেবো। একা থাকার পরিবর্তে সম্মিলিতে মিলে থাকার প্রতীক হচ্ছে বাশি। একাকী নিরবতায় কার সাথে বলো আমি ফাইট করি ? সংস্কার করার আগে বিতর্কের হাওয়াই সেতু পর্যবেণ করা চাই। তাই সেতুতে ওঠার জন্যে স্পোর্টিং কারের ভঙ্গিতে হালকা ও শলাকার আট পা বাড়াই।



সাঈদ জুবেরী
ঢেউ
.......
তীরের দিকে ছুটে আসা একটা ঢেউ বালিশের কাছে এসে থামে
চোখ মেলেতেই দেখি চলে যাচ্ছে ফিরতি স্রোতের মিছিলে—সমুদ্র গর্ভে

বালিশ ভেজানো ঢেউটিকে ধরব বলে
দ্রুত অনুসরণ করি স্রোতের মিছিল—আর সমুদ্র
ঢেউগুলোকে তখন টেনে নিচ্ছিল নিজের দিকে,
একসময় ঢেউগুলো সব কোন বিন্দুতে মিলালো—আর
আমি বালুময় ঢালে কয়েক মাইল ভেতরে একলা দাঁড়িয়ে...

হঠাৎ সমুদ্র ফিরিয়ে দিলো ঢেউ

এ ছিলো ডুবে যাবার আগের পটভূমি
পরের কাহিনী উদ্ধারকারী বোটের পাটাতনে রেখে এসেছি

এখন সমুদ্র তীরে বসে আছি
আর নন্দনতাত্ত্বিক ঢেউ আমার পা ছুঁয়ে
চলে যাচ্ছে গভীর সমুদ্রে



হাঁটুপানির জলদস্যু
বোকাদের পদ্য ০৩৮
.................
সরু খাটে পাশ ফিরে শুতে গিয়ে মনে হয়
ভালোবাসা আছে
অন্ধকারে ঠিক যেন নিজেকে না খুঁজে পাওয়া মদমত্ত হাতির মতোই
টের পাই, সূক্ষ্মশির ডাঙস মুঠোয় নিয়ে
বোবা মাহুতের মতো
ভালোবাসা আছে


যেমন আছেন তিনি জলে, স্থলে, আখ মাড়াইয়ের কলে
কেবল নিজের ঘ্রাণে ভরা এই আমার কম্বলে
হয়তো ঈশ্বর আছেন
শীতের অনেক রাতে মনে হয়
ভালোবাসা আছে, আছে ঈশ্বরের কাঁধে মাথা রেখে
তাঁর বিধবা কন্যার মতো, অযথা নিশ্চুপ আর বিব্রত ...
তবুও আছে, আছে।


আমার মাথার কাছে, অন্ধকার
আমার খাটের নিচে, অন্ধকার
ক্ষণিক আস্তিক হয়ে ঘুমাই, ঘুমিয়ে পড়ি
মনে হয়, ভালোবাসা ... আছে
সরু খাটের এক পাশে অভিকর্ষের মতো
পাশের বাড়ির মূক বেড়ালছানার মতো
আছে।

1 comment: