Thursday, August 19, 2010

জহির রায়হান : অন্তর্ধান বিষয়ে ১৯৭২ সালের একটি লেখা

সাংবাদিক পার্থ চট্টোপাধ্যায় জহির রায়হানের সঙ্গে দেখা করেন তাঁদের কায়েৎটুলির বাসায়। ১৩ ডিসেম্বর তার অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারকে দুপুরবেলা আল বদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। ১৪ ডিসেম্বর তাকে হত্যা করা হয়। বাড়ির প্রত্যেকের মত জহির রায়হানও এ হত্যাকাণ্ডকে মেনে নিতে পারেননি। তিনি পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে বললেন, আমার বিশ্বাস দাদা এখনো বেঁচে আছেন। বউদিও তাই বিশ্বাস করেন। কিন্তু সম্ভব-অসম্ভব অনেক জায়গায়তো খোঁজাখুঁজি করছি--
-মৃতদেহ কি শনাক্ত করতে পারেননি?
--আন্দাজে শনাক্ত করা হয়েছে। ডেডবডিগুলো এমন বিকৃত হয়ে আছে যে কিছু বোঝা মুশকিল। তাই এখনো সকলের মনে ক্ষীণ আশা তিনি বেঁচে আছেন।
--কারা কারা এই ঘটনায় জড়িত কিছু ধরতে পারলেন?
--একজনকে পাওয়া গিয়েছে। সে স্বীকার করেছে যে সে কালপ্রিটদের চেনে। নামও বলেছে। কিন্তু তাদের কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না।

... এর কয়েকদিন পরে জহির রায়হান একটি ফোন পান। তাঁকে জানানো হয়, তাঁর দাদা শহীদুল্লাহ কায়সারকে মীরপুরে আটকে রাখা হয়েছে। তিনি মীরপুরে চলে যান। এরপর জহীর রায়হানকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। সেদিন ছিল ৩০ জানুয়ারি, ১৯৭২।
পার্থ চট্টোপাধ্যায় লিখছেন, জহির রায়হান প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, যে সাম্প্রদায়িক চক্র ঢাকার বুদ্ধিজীবী হত্যার পিছনে দায়ী তাদের তিনি নির্মূল করবেন। এই উদ্দেশ্যে তিনি ঢাকায় বুদ্ধিজীবী নিধন অনুসন্ধান কমিটি স্থাপন করেন। কমিটির অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন, 'হলিডে' কাগজের সম্পাদক এনায়েতুল্লাহ খান।
এই বুদ্ধিজীবী অনুসন্ধান কমিটির অফিস হয়েছিল ঢাকা প্রেসক্লাবে।

জহির একদিন আমাকে বলেছিলেন, প্রেস ক্লাবে আসুন। বহু চাঞ্চল্যকর তথ্য উদ্ধার করেছি। আপনাকে দেখাব।
আমি বলেছিলাম, এখন কি আর কাউকে খুজে পাবেন? এসব পণ্ডশ্রম হচ্ছে আপনার। আর তা ছাড়া স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে গেছে। আর তারা কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। যা মারা গেছে তাকে কেন আবার খুঁচিয়ে তুলবেন।
জহির বলেছিলেন, এখানে আপনার সঙ্গে আমি একমত নই। যারা বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী তারা সাময়িকভাবে গা ঢাকা দিয়েছে বটে, কিন্তু তারা বাইরে কোথাও যায়নি। এই দেশেই আছে। আবার ঐক্যবদ্ধ হতে চেষ্টা করছে। আপনি ভাববেন না, সাম্প্রদায়িক শক্তি চিরদিনে মতো খতম হয়ে গিয়েছে।
জহির বলেছিলেন, আপনাকে আমি ওদের গোপন লিফলেট দেখাব। তাতে ওরা লিখেছে, আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়নি--সবে শুরু। আপনি প্রেসক্লাবে আসবেন, বহু দলিল দেখাব।
নামধাম ঠিকানা সব পেয়েছি--তাদের কিছুতেই নিষ্কৃতি দেওয়া হবে না--আই স্যাল ফাইট আনটু দি লাস্ট।


প্রেসক্লাবে গিয়েছিলাম নির্ধারিত সময়ে। কিন্তু যথারীতি জহির সেদিনও কথা রাখেননি। আলাপ হল এনায়েতুল্লাহর সঙ্গে। আমাকে বললেন, কাগজপত্র সবতো জহিরের কাছ।...
সাম্প্রদায়িক চক্র সম্পর্কে জহির রায়হান বহু তথ্য উদ্ধার করেছিলেন। এ কাজেই তার কাল হল। তিনিও নিখোঁজ হলেন। ম্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের হাতে তাদের সবচেয়ে বড়ো শত্রুর জীবন এভাবেই শেষ হয়ে গেল।''

জামায়াতের পত্রিকা দৈনিক নয়া দিগন্ত আর দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা জহির রায়হানের অন্তর্ধান দিবস উপলক্ষ্যে নিবন্ধ ছেপেছে। সেখানে তারা বলার চেষ্টা করেছে- জহির রায়হানের হত্যাকাণ্ডের পেছনে তৎকালীন আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্র ছিল এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় তাকে শেষ করে দেওয়া হয়। এমনকি তারা বঙ্গবন্ধুকেও তারা দায়ী করার চেষ্টা করেছে। জামায়াতের এই অপপ্রচারের জবাবে পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের লেখাটি পড়ে মনে হল, সব সত্যকে চাপা দেওয়া যায় না। অনেক সৎ দলিল রয়ে গেছে ঘাতকদের সমুচিৎ জবাব দেওয়ার জন্য। সেগুলো খুঁজে বের করা দরকার।

নোট :
সাংবাদিক পার্থ চট্টোপাধ্যায় ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১ ঢাকা পৌঁছান। তারপর পাঁচমাস তিনি ঢাকায় থেকে যান। সেই সময়কার লেখা ডেটলাইন ঢাকা নামে উল্টোরথ পত্রিকায় সেসময় ছাপা হয়েছিল। পরে ২০০৪ সালে পুনশ্চ প্রকাশন, ৯এ, নবীন কুণ্ডু লেন, কলকাতা থেকে বই আকারে বের হয়।

.................................
সাংবাদিকের ডায়েরি
পার্থ চট্টোপাধ্যায়
মূল্য ১৫০ টাকা

No comments:

Post a Comment