আন্তন চেকভ একটি চিঠি লিখেছিলেন গোর্কিকে। বলেছিলে--'তুমি একজন আর্টিস্ট। তোমার অনুভব-ক্ষমতা অসাধারণ; তোমার কাছে অনুভূতি আকার পায়। যখন তুমি একটি বস্তুর বর্ণনা দেবে, তখন তুমি যেন তা দেখতে পারো আর হাত দিয়ে ছুঁতে পারো। এই হবে যথার্থ লেখা।'
ভাষা হবে লেখকের ক্রীতদাস, আদেশ মাত্রেই তা কার্য সমাধা করবে, লেখকের অনুভূতি বা চিন্তাকে সাকার রূপ দেবে। এখানেই লেখার স্টাইলের চরম সার্থকতা। এরই জন্য লেখক দিনের পর দিন সাধনা করেন।
যে-কোনো গদ্যরচনা বা কবিতায় লেখক ব্যক্তিত্বের এমন-সব গুণ ও বৈশিষ্ট্য প্রকাশ পায়, যেগুলিকে বিচ্ছিন্ন করে দেখানো যায় না, অথচ অনুভব করা যায়, এবং সেইসব গুণের যোগফল লেখক-ব্যক্তিত্ব, এমত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়, তাকে এক কথায় বলা যায়- স্টাইল।
স্টাইল হচ্ছে লেখক মানুষটি।
ফ্লোব্যের বলেছেন, স্টাইল হচ্ছে লেখকের বিভিন্ন বস্তুকে দেখার বা চিন্তা করার একান্ত নিজস্ব ভঙ্গি। স্টাইল ভাষার এমন একটি গুণ যা লেখকের বিশিষ্ট চিন্তা-ভাবনা-অনুভূতিকে অব্যর্থভাবে যথার্থ্যের সঙ্গে পাঠকমনে পৌঁছে দেয়। পাঠকমনের সঙ্গে লেখকের যোগাযোগের সেতু। শব্দ, বাক্য, চিত্রকল্প, অলংকারের অবরণ-মণ্ডিত যে লেখক-ব্যক্তিত্ব, তারই নাম স্টাইল। তা ব্যক্তির পোষাক নয়, তার রক্ত মাংস আর হাড়।
স্টাইলের ছয়টি গুণ :
স্বচ্ছতা, সরলতা, পরিমিতি, বৈচিত্র্য, নাগরিকতা ও সরসতা।
মনোভাব প্রকাশেই ভাষার সার্থকতা। একজন অন্যজনের কাছে তার মনোভাব প্রকাশে ভাষার সাহায্য গ্রহণ করে। স্বভাবতই ভাষা যত স্বচ্ছ হবে স্পষ্ট হবে, মনোভাব ততই স্পষ্ট হবে।
বঙ্কিম চন্দ্র বলেছেন--যিনি সোজা কথায় আপনার মনের ভাব সহজে পাঠককে বোঝাতে পারেন তিনিই শ্রেষ্ঠ লেখক। লেখার উদ্ধেশ্য পাঠককে বোঝানো। এটা সরলতা।
অতিকথন বর্জন করে মিতভাষণে, অসংযত ভাবোচ্ছ্বাস বর্জন করে আত্মসংযত পরিমিত বক্তব্যে উপনীত হবার সাধনাই স্টাইলের সাধনা।
লেখায় বৈচিত্র্য থাকতে হবে। বৈচিত্র্যহীন তীক্ষ্ণাগ্র সংহত চিন্তাসমৃদ্ধ রচনা অনেক সময় পাঠকমনের এতবেশি মনোযোগ ও আনুগত্য দাবী করে যে রচনার মূল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হয়ে যায়।
চিত্তবৃত্তির বাহুল্যবর্জিত আভিজাত্য, বুদ্ধিপ্রবণ মননশীলতা, যুক্তিধর্মিতা ও প্রাণের সজীবতা নাগরিকতা-গুণের লক্ষণ। এর বিপরীত কথা হচ্ছে গ্রাম্য বা অশ্লীলতা। যে কথা শুনে লজ্জা ঘৃণা অথবা অমঙ্গলের আশংকা উদয় হয়, সে বাক্যই অশ্লীল। সহৃদয় সামাজিকের (কালচার্ড মানুষ) মনে যদি লজ্জা বা ঘৃণার ভাব জন্মে, তবে উৎস যে রচনা, তা অশ্লীল, গ্রাম্য। গ্রাম্যতা হল- চিত্তের অনুদারতা, দৃষ্টির সংকীর্তনতা, যে কোন পরিবর্তনের প্রতি বিমুখতা, শ্রেষ্ঠাত্বাভিমান।
সরসতা গুণের জন্ম লেখকের সহাস্য রসিকতায়, উদার জীবনদৃষ্টিতে, জীবনসম্ভোগের আনন্দে। এই গুড হিউমার দেয় বা সরসতা লেখাকে দেয় স্বাদুতা, পাঠকের মন ভরে ওঠে এক অনাস্বাদিতপূর্ব আনন্দে। অসূয়া, ঈর্ষা, দ্বেষ, ঘৃণা, ক্রোধ, জুগুপ্সা এই সরসতার বিপরীত।
মলিয়েঁর তার কোন লেখা শেষ করেই তার রাধুঁনীকে পড়ে শোনাতেন। রাঁধুনিটি ছিল অশিক্ষিত। রাঁধুনীটি যদি হেসে উঠত তবে বুঝতেন লেখা ঠিক হয়েছে। সার্থক হয়েছে। তিনি কোনো পণ্ডিতের কাছে যেতেন না।
খুব দরকারী একটি বই কিনুন-
বাংলা গদ্যসাহিত্যের ইতিহাস
অরুণকুমার মুখোপাধ্যায়
Thursday, August 19, 2010
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment