আমাকে বিপদে ফেলেছেন তিনজন। ডোবার ব্যাঙ, অমি রহমান পিয়াল এবং নুরুজ্জামান মানিক।
এদের কাউকে আমি চিনি না। চেনার কথা নয়। আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরছি। নদীতে নদীতে কাটিয়েছি। গাছপালার চিকিৎসাকর্ম কিছু জানা ছিল। লেখালেখির জগৎ নিয়ে কোন মাথাব্যথা ছিল না। এই লেখালেখি আমাকে খেল।
আমি শুদ্রবংশের ছেলে। টুকটাক লেখাপড়া আর বাপের ক্ষুদ্র ব্যবসাতি নিয়ে দিন কেটেছে। ১০০% জন্ম গৃহহীন। সেজন্য বিপ্লবের প্রতি ভরসা ছিল। বিপ্লব এলে সত্যিকারের মাথাগোজার ঠাঁই পাব। এই বিপ্লব ব্যাটাই আমাদের চোখের সামনে থেকে নাই হয়ে গেল। বার্লিন কোন সুদূরের দেশে। সেখানে একটি দেয়াল ভেঙে পড়ল। আর আমাদের বাংলাদেশের গণ্ডগ্রামের কয়েকটি হৃদয় তার নিচে চাপা পড়ল। সে রক্তপাত এখনো চলছে। হায়, ভ্লাদিমি ইলিস, তুমি কোথায়? তুমি অভিশপ্ত হও।
কবিতা লিখে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছিলাম। নদী নিয়ে কবিতাটি লেখা। ‘নদী মরে গেলে সত্য হারিয়ে যায়’। সেটা ১৯৮৪ সালের ঘটনা। এটাকে কবি মোহাম্মদ রফিক আর নির্মলেন্দু গুণ আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক উৎসবের সেরা কবিতা নির্বাচন করেছিলেন। কয়েকজন কবিজনোচিত লোকজন আমাকে ঘুরে ঘুরে দেখলেন। আর বললেন, ধুস, একে দিয়ে হবে না। এ শালা গাজা খায় না। মদ খায় না। চা-ও খায় না। রাত বিরেতে হল্লা করে না। নদী টদি নিয়ে কবিতা লেখে। বাতিল।
আমি ভাই রোগাপটকা মানুষ। পকেটের চেহারা আরও খারাপ। দিন কেটে যায় একা একা। আধা খেয়ে- সাধা খেয়ে। এ রকম না খাওয়া পার্টির সঙ্গে দুএকবার সায়ংকালে ঘুরে ফিরে মাথার গোঁজার ঠাঁই হল। পরে দেখি- এরা স্টার সিগারেট টানে। আর বসে বসে ঝিমোয়। মাঝে মাঝে দুএকজন ডিম ভাজি খায়। খেতে খেতে তাদের বাড়ির সিংহ দরোজার গল্প করে। এখানে আমার মতো নাই-বাড়ির লোকজন খুবই অচল।
একটি মেয়ে একদিন আমাকে বলল, তুমি কবিতা লেখ?
আমি কিছু বলার আগেই নেতা ওকে ইশারা করে ডাকলেন। মার্কস এঙ্গেল আউড়ে বললেন, ওর কোনো ভবিষ্যৎ নেই। ও বিপ্লবের অচল মাল।
কিন্তু আমি তো সত্যি সত্যি বিপ্লবকে ভালবাসতাম। বিপ্লব এলে আমার জননী যে তুলসী তলায় প্রদীপ জ্বালে সেটা সত্যি আমার মায়ের হত। কেউ বলতে পারত না, এটা তোমাদের বাড়ি নয়। তোমরা সর্বহারা। আহা, বিপ্লব, তুমি কেন রেড স্কোয়ারে মুখ থুবড়ে পড়লে? কমরেড ফরহাদ, তোমার নামে প্রদীপগুলো নিভে যাক।
আমি তখন কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়ে লোকজনের ফাইফরমাস খাটতে শুরু করেছি। এর মধ্যে এই সব ঝিম মারা বিপ্লবীরা কোন ফাঁকে আমার নামে একটা পোস্টার সেঁটে দিল- কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক পদে এই গোবেচারাকে ভোট দিন। আমি এসব জানতেই পারিনি। আমি তখন মধুপুরের জলছত্রে। কুষ্ঠ আশ্রমের পাদ্রী মহাশয়দের সঙ্গে ঈশ্বরের বাক্য পাঠ করছি- আর প্রভুর দুই নম্বর মেষ হয়ে ফ্রি খাওয়া খাচ্ছি। কারা কারা যেন যথাযোগ্য লোক না পেয়ে আমার মতো গোবেচারাকে সিল পিটিয়ে দিল। ভোটগুলো জলে পড়েছে। ছাত্র সংসদ যে আগামী দিনের ঘড়ের মাল তৈরির কারখানা এটা বুঝতে আমার সময় লাগল না। সদাপ্রভু আমাকে রক্ষা করলেন। ওরা বলল, এই লোকটা চাঁদাবাজি ছাড়া বিপ্লব করতে চায়। হা হা হা। বেঁচে থাকুক তাহাদের এই হা হা হা।
কিছুদিন পরে একজন প্রফেসর জিজ্ঞেস করলেন, বৎস, তুমি এই নিউটনী কোটখানা কোথায় পাইয়াছ?
বলিলাম, আমার সঞ্জীব দিয়াছে।
-এই শার্টিটি কাহার?
-বাতেনের।
-এই ঢলঢলে প্যান্টটি?
-কোনো মাদামোয়াজেলের নহে আর্যে। উহাও একজন বন্ধু মাসুদের। তিনি কিঞ্চিৎ ফাউভোজী।
-মোকাসিনটি?
-মুচির দোকান হইতে ভাড়া লইয়াছি। দৈনিক পাঁচসিকা।
-মার দিয়া কেল্লা। প্রিয় ভদ্রে, তোমার প্রিয় কর্ম কি?
-ঝিমানো।
তিনি রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন। বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, পারফেক্ট। সিভিল সার্ভিসের জন্য ইহার যোগ্য আর কেহ নাহি। যাও বেটা। উপজেলাজেলায় যাও। ঘাস কাটো।
আমি দীর্ঘ পনেরটি বছর গ্রমে গ্রামে ঘাস কেটে বেড়িয়েছি। এই ঘাসের বর্ণ আমার মর্মে গেঁথে গেল। আহা আর্যে, প্রফেসর এবিসিডি আপনার টাকে অতি সুচিক্কন ঘাস গজাক।
গজানোর আগেই সদাপ্রভু তার এই নাদান মেষশাবককে প্লেনে তুলে দিলেন। কহিলেন, ওহে বৎস, নয়ন মেলিয়া দ্যাখো- হুই যে হাডসন নদী। ইহার ভিতরে আমি হস্ত উত্তোলনপূর্বক দণ্ডায়মান হইয়া স্বপ্ন বিতরণ করিতেছি। চাহিবামাত্র বাহককে দিতে বাধ্য থাকিব।
স্বপ্ন দূর থেকে দেখা ভাল। কাছে গেলেই বিপদ। স্বপ্নকে দেখে বড় বিস্মিত হলাম। বিস্ময় ভাঙতে সোজা হাসপাতালে। ডাক্তার ধীরে ধীরে আমার কানে কানে কহিলের, প্রিয় বয়স্য, অচেতনে কি কহিয়াছ একটু বুঝাইয়া কহিবে কি? তিনি একটি টিপ রেকর্ডার চালাইয়া দিলেন। শুনি, কোন এক আমি কহিতেছি- রূপ নারাণের কূলে জেগে উঠিলাম। জানিলাম এ জগৎ স্বপ্ন নয়। সত্য যে কঠিন। কঠিনেরে ভালবাসিলাম। ডাক্তার অনেক কষ্টে এই কথাগুলি অনুবাদ করে তার দরোজায় টানিয়ে দিলেন। নিচে লিখেছেন আমার নাম। আঁতকে উঠলাম। বললাম, বেটা ভগুচগু, ওটা রবীন্দ্রনাথের কবিতা।
রভীন-ড্রন- নাট? উহাকে চিনি না। যে ব্যাটার নাম খটোমটো তাহাকে আমার দরকার নাই।
কিন্তু রবীন্দ্রনাথকে আমার দরকার। জীবনের প্রতি পদে পদে দরকার। আকণ্ঠ যন্ত্রণায় ডুবে তিনি আনন্দ ছেঁকে এনেছেন। এ লোকটাই আমাকে বুঝেছেন।
এই সময় আমি হাঁটতে ভুলে গেলাম। খাওয়া দাওয়া ঘুম- বিলকুল গায়েব। কোথাও কোন ক্রন্দন নেই। শুধু আমার ভিতরে আছে। সেকি বাঁচার জন্য? না, মরে যাওয়ার জন্য –জানি না। শুধু জানি মাঝে মাঝে আমি মরে যেতাম। ডাক্তার তখন বলতেন, প্রিয় বয়স্য, দ্যাখো- তোমার মেয়েদের চেয়ে দ্যাখো। আমি তখন বেঁচে উঠতাম।
আমার মেয়ে দুটি শান্ত। ডাল খায়। ভাত খায়। ছোট মেয়েটি বলল, জানো বাবা, ক্যান্ডি খেতে আমার ভাল লাগে না। দাঁত নষ্ট হয়। বড়োটি নভেল লেখা শুরু করল। পাঁচশত পৃষ্ঠা লিখবে। এই ঢাউস নভেল প্রকাশিত হলে প্রকাশক অনেক ডলার দেবে। ডলার ছাড়া সংসার অচল। ঠিক এ সময় আমার স্ত্রী চাকরী হারাল।
আমি ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করেছি। হেঁটে হেঁটে কাজে যাই। দেখতে পাই- আমি একা নই। দুইজন লোক। একজন অসীম যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছে। পিছন থেকে আরেকজন কানের কাছে বলেই যাচ্ছে- থেমো না। হাঁটো। হাঁটতে থাকো। সামনের মানুষটি আমি। পিছনের মানুষটিও আমি। দুজনেই ক্লান্ত। শ্রান্ত। অবসন্ন।
এইসব দিনে অনন্ত দুঃখের মধ্যে আমি একটি অক্ষর লিখি। লিখি দুটি অক্ষর। কাঁপতে কাঁপতে লিখি একটি শব্দ। পূর্ণ একটি বাক্য। মরে যেতে যেতে লিখি একটি পাতা। এক পাতার গল্প। দীর্ঘশ্বাসের। বেদনার।আর হাহাকারের।
কেন জানি ডোবার ব্যাঙ আরেকটি গল্পের আবদার করে বসলেন। তার ভঙ্গিটি আমাকে আরেকটি গল্প লেখাল। ডাক্তার দেখেশুনে বললেন, ওকে। চালিয়ে যাও। থেম না। আমার মেয়ে দুটি আমার পাশে বসে লিখতে শুরু করে দিল। লিখতে লিখতে বলল, বাবা, লেখ বাবা।
লিখতে লিখতে দেখি, আমাকেই লিখছি। লেখার মধ্যে দিয়ে কোন এক আমি উঠে আসছে। ছেঁড়া খোঁড়া। পরাজিত। শুদ্র মানুষ। গৃহহীন মানুষ।
অমি রহমান পিয়াল উস্কে দিয়ে বললেন, একাত্তরকে নিয়ে লিখুন। বাহাত্তরকে নিয়ে লিখুন। পচাত্তরকে নিয়ে লিখুন।
এগুলোতো লিখছেন অমি রহমান পিয়াল। নূরুজ্জামান মানিক। ওদের লেখার মধ্যে দিয়ে ইতিহাস কানাগলি থেকে বেরিয়ে আসছে। অণ্ধকারের ভিতর থেকে ভাঙাচোরা আলো ফিরে আসছে। পথ দেখতে পাচ্ছি।
এই পথ দেখতে পাওয়াটা বিপদ। পথ জানা থাকলে আবারো বিপ্লবের ফেরার সম্ভাবনা জাগে। আবার মনে মনে আশা জেগে ওঠে- আমার মায়ের তুলসী তলাটি ফেরত পাওয়া দরকার, যেটি তার নিজের। কেউ তাকে বলবে না, তোমার কিছু নেই। শূন্য।
হায় শূন্যতা, তুমি আর কতকাল রহিবে আমাদের ঘাড়ে?
...................
কাকমানুষের চকখড়ি
গল্পগ্রন্থ
প্রকাশক : আমার প্রকাশনী।
Thursday, August 19, 2010
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment