Thursday, August 19, 2010

কিশোরী শাহীন, কাশফুল এবং নূরেমবার্গ ট্রায়ালের রেকর্ডভুক্ত নারীর ছবি



মেয়েটি কাশফুল ভালবাসত। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে ফুটত কাশফুল। একদিন বলল আঙ্কল, আমাকে নিয়ে যান। আমি দুর্গা দিদি হতে চাই। শাদা কাশফুল হতে চাই।
এখানে সম্ভব অপু-দুর্গা হওয়া। একটু অপেক্ষা করলেই অপর পার থেকে ট্রেন আসে। কু-উ-উ শব্দ করে। নদীর উপর দিয়ে শ্যামগঞ্জ থেকে হাওয়া মেখে আসে এই ট্রেনটি। আসে পূর্বধলার লোকজন।

শাহীন একদিন পূর্বধলা যেতে চেয়েছিল।

এইসব ১৯৭১ সালের আগের কথা। শাহীনদের বাসাটি ছিল পুকুর পাড়ের পশ্চিপ্রান্তে। ওর আব্বু কাজ করতেন ময়মনসিংহে-- কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক আব্দুর রহিম। পাক আর্মি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি হলে ঘাঁটি গাড়ে। অনেক লোকজনকে ধরে এনে ছাত্রদের কক্ষের মধ্যে পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছে। আমি ১৯৮৪ সালেও দেখেছি আওয়ালের রুমের ফ্লোরে পোড়া মানুষের দাগ। এখনো আছে। আমি এই রুমের মধ্যে কখনো ঘুমোতে পারিনি।

বধ্যভূমিতে শহীদের করোটিতে শ্বেতদ্রোণ ফুল : কেওয়াটখালির কাছে কৃষি বিশ্বদ্যালয়ের অতিথি ভবনের পাশে। আলোকচিত্র : নাইবউদ্দিন আহমদ।
নাইব চাচা--আলোকচিত্রশিল্পী নাইব উদ্দিন আহমদের সম্বল মাত্র একটি রোলিফ্লেক্স ক্যামেরা। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে বাঙালিদের ধরে এনে ব্রাশ করে পাকবাহিনীরা মেরে ফেলেছে। নদীর জল হয়েছে লাল। ভেসে গেছে জলের সঙ্গে।
কাশবনের ভিতর থেকে নাইব চাচা দেখেছেন পাশেই গড়ে উঠেছে বধ্যভূমি। এইখানে দিনে রাতে শিয়াল কামড়ে টানাটানি করে সদ্য গুলি করে মারা লাশ। কোনো কোনোটি গলে পচে গেছে। কোনো কোনোটির কেবল করোটি আছে। তার মধ্য দিয়ে শ্বেতদ্রোণ ফুল ফুটেছে। আর উড়ে আসছে শকুন।

একদিন খবর পেলেন শাহীন হাসপাতালে। বাইরে শাহীনের আব্বু মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছেন। একবারে ভেঙে পড়া। তাকিয়ে দেখার শক্তি নেই। ভিতরে শাহানা চিৎকার করে কাঁদছে। মাথার চুলগুলো এলামেলো। আম্মু শাহানাকে ধরে রাখতে পারছেন না। বলছে- আম্মু ওরা আমাকে মেরে ফেলেছে। আমাকে বাঁচাও।

শাহীন তখনো বেঁচেছিল। মরতে মরতে বেঁচেছিল। নরপশু পাকআর্মিরা আত্ম সমর্পন করার পরে তাকে একটি কক্ষ থেকে বের করে আনা হয়েছে। হাঁটতে পারেনা। মুখের চামড়া উঠে গেছে। খুবলে খুবলে খেয়েছে গায়ের মাংস। বলেছে- তোর পেটে সাচ্চা পাকিস্তানী আদমী পয়দা দিয়েছি।
নাইব চাচার পায়ের শব্দ চিনতে পেরেছিল শাহীন। আহা, আমাদের হৃদয়ের বোন এই কিশোরী মেয়েটি। কাশফুল ভালবাসত। কাশফুলের ভিতরে যেতে চেয়েছিল চাচার সঙ্গে। হতে চেয়েছিল ছবি।

গ্রামটির নাম নিলক্ষ্যা। এখানেই পাক আর্মি চলে যাওয়ার পরে এই ছবিটি তুলেছিলেন নাইব চাচা।
চাচাকে দেখে চেঁচিয়ে উঠেছিল- ওরা আমাকে মেরে ফেলেছে। আমাকে বাঁচান।

শাহীন নামের সেই মেয়েটি বাঁচতে চেয়েছিল। কিন্তু মুখ ঢেকে রেখেছিল চুল আর হাতের আড়ালে। মুখ দেখাবার জন্য কিছু তো রাখেনি পাক হানাদার নরপশুরা। তাকে বাসার সামনে থেকে জামাতী নরপশুরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল। তুলে দিয়েছিল সোহরাওয়ার্দী হলে। পাকিস্তানী হায়নাদের কাছে। কিশোরী মেয়েটির আর কাশবনে যাওয়া হয়নি।

শাহীন এর পরই সত্যি সত্যি মরে গিয়েছিল। কাশবনের পাশে তাকে শুইয়ে রাখা হয়েছিল। ব্রহ্মপুত্রের পাড়ে। কিন্তু শাহীন রয়ে গেছে নাইব চাচার রোলেক্স ক্যামেরায়। আজও - উনচল্লিশ বছর পরেও। আর তার হাহাকার। নাইব চাচার চোখ ভরে এসেছে জলে। শাহীনের ছবিটি দেখাতে দেখাতে বলেছিলেন-- খোকন, আমার মনের ক্যামেরায় এরচেয়ে অনেক অনেক ভয়ংকর ছবি তোলা আছে। আমি চোখ বুঝলেই দেখতে পাই। সেই সব চোখ ভর্তি ছবি নিয়ে গত ডিসেম্বরে চিরকালের জন্য নাইব চাচার চোখ স্বব্ধ হয়ে গেছে। তিনিও এখন কাশফুল।

ডালাস থেকে মাহাবুব জালাল ভাই একটি ছবি আমাকে পাঠিয়েছেন। বললেন, দেখো। পোলান্ডে হিটলারী বাহিনীরা শাহীনদের মতো মেয়েদের নগ্ন করে হাঁটিয়ে নিচ্ছে কনসেন্ট্রশন ক্যাম্পে। হিটলার বাহিনীকে কিন্তু ছেড়ে দেওয়া হয়নি। তাদের বিচার হয়েছে। বিচার হচ্ছে আজও তাদের সহযোগীদের।


তিনি মুজিব মেহদী আর রোকেয়া কবীরের মুক্তিযুদ্ধ ও নারী গ্রন্থ থেকে একটি পৃষ্ঠা আমাকে পাঠিয়েছেন। লেখা...'মেয়েদের ধরে আনা হলে কে কোথায় যাবে এবং তালিকা অনুয়ায়ী নির্ধারিত অফিসারের কাছে নির্দিষ্ট মেয়েকে পাঠানো হতো। বন্দি হারেস উদ্দিন ১২ নম্বর ব্যারাকের ১০ নম্বর কামরায়ও ৫০ জন নারীকে দেখতে পেয়েছিলেন। তিনি জানান, বন্দি মেয়েদেরকে তিনভাগ করা হতো। প্রথম ভাগে থাকত যুবতী, দ্বিতীয় ভাগে মধ্যবয়সী এবং তৃতীয় ভাগে সন্তানের মাতা। তিনি জানান, স্কুল-কলেজের অল্পবয়েসী কিশোরীদের বিমানে করে ঢাকায়ও পাঠানো হতো। আরেকটি ঘটনায় জানা যায়, ভারতগামী একদল শরণার্থীর সবাইকে হত্যা করে তাঁদের মধ্য থেকে ১৫ জন কিশোরী-যুবতীকে পরণের কাপড় খুলে সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় কয়েক মাইল হাঁটিয়ে মহেশপুরে নিয়ে আসা হয়। যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত এসব মেয়েদের ভোগ করবার জন্য আটকে রাখা হয়।

কুষ্টিয়ার পাক-ছাউনিতে অজস্র গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে সেখান থেকে একাধিকবার গৃহবধু থেকে শুরু করে অল্পবয়সী সকল মেয়েকে ধরে নিয়ে আসা হয় এবং নয়মাসব্যাপী যথেচ্ছ ভোগ করা হয়। স্বাধীনতার পর এখানকার কেউ কেউ জীবিত অবস্থায় ছাড়া পান।'

শাহীনদের যারা ধরে নিয়েছিল, নির্যাতন করেছিল করেছিল, মেরে ফেলেছিল--তাদেরকে কি ছেড়ে দেওয়া যায়? দেওয়া কি উচিৎ?

এই প্রশ্নটি রেখেছেন জালাল ভাই। তিনি আরেকটি কথা বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের দলিলের অষ্টম খণ্ডে বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধের আলোকচিত্র প্রকাশ করেছে। সেগুলো এখন রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি। কিন্তু বাংলাদেশে দৃকে'র ডঃ শহীদুল আলম আলোকচিত্রশিল্পীদের কাছ থেকে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সেইসব ছবির স্বত্ত্ব টাকা দিয়ে কিনে নিয়েছেন। দৃকের মাধ্যমে তিনি অগাধ ধনসম্পদের মালিক। কিন্তু রাষ্ট্রীয় সম্পদ এই ছবিগুলি তিনি কিভাবে কেনার সুযোগ নিলেন? বিশ্বযুদ্ধের ছবিগুলো কিন্তু কেউ কেনার সাহস করে নি। বাণিজ্য করার কোসেস করেনি। ওগুলো পৃথিবীবাসীর সম্পদ। ডঃ শহীদুল আলম ফরহাদ মজহার ঘরাণার লোক। ফরহাদ মজহারতো একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে ফ্যাসিবাদি কর্ম বলেই মনে করেন। যুদ্ধপারাধিদের পক্ষে কলম ধরেন। তাঁর সুহৃদ ডঃ শহীদুল আলমের এই মুক্তিযুদ্ধের দলিল ছবিগুলো কিনে নেওয়ার মাজেজাটা কি?

No comments:

Post a Comment